অল সোলস ডে: আগুনের পরশ ছুঁয়ে পূণ্যময় জীবনের প্রার্থনা
২ নভেম্বর ২০১৯ ২০:১৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: কবরে মোমবাতি জ্বেলে, ফুল ছিটিয়ে প্রয়াত স্বজনদের স্মরণ করেছেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী হাজারো নারী-পুরুষ, শিশু। আগুনের পরশ প্রাণে ছুঁয়ে মহান প্রভুর কাছে পূণ্যময় জীবনের প্রার্থনা করেছেন তারা।
শনিবার (২ নভেম্বর) শেষ বিকেলের আকাশে যখন বিদায়ী সূর্যের লালচে আভা উঁকি দিচ্ছিল, তখন থেকেই চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটার রাণী জপমালা গির্জার কবরস্থানে জড়ো হতে থাকেন শোকার্ত স্বজনেরা।
প্রতিবছরের মতো এবারও অল সোলস ডে-তে কবরে ফুল ছিটিয়ে, মোমবাতি জ্বেলে, আগরবাতির সুঘ্রাণ ছড়িয়ে তারা স্বজনের জন্য অনন্তলোক প্রার্থনা করেছেন। সন্ধ্যার পর রাতের আগমনী বার্তা নিয়ে আসা অন্ধকার আলোকময় হয়ে ওঠে হাজারো মানুষের প্রার্থনার আলোয়।
১৯৮৭ সালের ৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন এমিলি ঈশিকা গোমেজ। মাত্র এক বছর চার মাস এই পৃথিবীতে ছিল এই শিশু। বিদায় নেয় ১৯৮৮ সালের ১১ জুলাই। তার কবর ছুঁয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন বাবা বেঞ্জামিন গোমেজ। মোমের আলোয় তার চোখে চিকচিক করছিল মেয়ের জন্য বেদনাশ্রু।
২০১৭ সালের ৭ জুন ইটালিতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কেনিট রায়। তার স্ত্রী-সন্তান থাকেন ইটালিতে। কবর পাথরঘাটায়। ভাতিজা কেবিন রায় দাদীকে নিয়ে এসেছিলেন চাচার কবরে শ্রদ্ধা জানাতে।
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ইউগান গঞ্জালেস ঢাকায় এক দুর্ঘটনায় মারা যান। ভাই এলটন গঞ্জালেস স্ত্রী লিজাকে নিয়ে এসেছিলেন ভাইয়ের কবরে মোমবাতি জ্বালাতে। পুষ্পস্তবক কবরে রেখে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন দুজন। পরে অংশ নেন প্রার্থনায়।
এলটন গঞ্জালেস সারাবাংলাকে বলেন, ‘বড় অসময়ে ভাইকে হারিয়েছি। আমার দাদা-দাদীকে হারিয়েছি আগে। মা-বাবা এখনও বেঁচে আছেন। ভাইকে হারানোর ব্যাথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। মহান প্রভু যেন ভাইকে স্বর্গলোকে স্থান দেন, সেই প্রার্থনা করি। গত আটমাস ধরে প্রতিদিন আমার মা-বাবা এসে ভাইয়ের কবরে বাতি জ্বালিয়ে দেন। আজ অল সোলস ডে-তে আমরাও এসেছি।’
১৯৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর জন্ম নেওয়া আন্না পাপড়ি হালদার ২০০১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। ২৬ বছর বয়সী আন্নার জন্য ফুল নিয়ে এসেছিলেন ভাবি ইভা রোজারিও। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন কবরের সামনে।
স্কুলশিক্ষিকা ইভা রোজারিও সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাত্র ২৬ বছর বয়সে আন্না আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মৃত্যু আমাদের সবার হবে। কিন্তু যেকোনো মৃত্যুই আমাদের ব্যথিত করে।’
চট্টগ্রামের বৃহত্তম এই গির্জায় শেষ বিকেলে শোক ও প্রার্থনা সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। আর্চবিশপ মজেস কস্তা সিএসসি এতে পৌরহিত্য করেন। জীবনের পাঠ চুকিয়ে পরপারে পাড়ি দেওয়া স্বজনদের জন্য প্রার্থনায় গলা মেলান সমবেত খ্রিস্টধর্ম অনুসারীরা। এসময় পরলোকগত স্বজনের আত্মা স্মরণের পাশাপাশি যুদ্ধবিগ্রহ অথবা হিংসাত্মক কাজের শিকার হয়ে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়।
আর্চবিশপ মজেস কস্তা বলেন, ‘যারা পরলোকগত হয়েছেন তাদের কারও সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক, কারও সঙ্গে আত্মীয়তা কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কিন্তু আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। আজ চলে যাওয়া প্রিয়জনদের আমরা অন্তরের খুব কাছ থেকে অনুভব করছি। প্রার্থনা করি, ঈশ্বর যেন তাদের স্বর্গে বরণ করে নেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজ শুধু প্রিয়জনের কবরে মোমবাতি জ্বালানো এবং ফুল ছিটিয়ে দেওয়ার দিন নয়। বরং আমরা যেন এই শিক্ষা নিই যে, অভাবী-দু:খী মানুষের পাশে থাকব, প্রতিবেশীকে নিজের মতো করে ভালোবাসব, অপরাধীকে ক্ষমা করে দেব। নিজেকে যেন আমরা অন্যরূপে গড়ে তুলি। আমাদের জীবন যেন পূণ্যময় হয়।’
‘আমরা নিজেরাও একদিন চলে যাব। মৃত্যু অবধারিত। জীবন যদি টাকা দিয়ে কেনা যেত, তাহলে কোনো ধনীর মৃত্যু হত না। তাই মৃত্যু সবার আসবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, অনন্ত জীবনে যেন আমাদের জন্য স্বর্গের দ্বার খোলা থাকে, আমরা যেন এমন পূন্যময় জীবন গঠন করতে পারি’, বলেন আর্চবিশপ
প্রার্থনা শেষে খ্রিস্ট ভক্তদের জন্য খ্রিস্টপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। ‘অল সোলস ডে’ উপলক্ষে নগরীর বিভিন্ন গির্জায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।