সংকুচিত হচ্ছে পুরনো শ্রমবাজার, আশা নেই নতুনের
৩ নভেম্বর ২০১৯ ০৮:২০
ঢাকা: শ্রমিকের দক্ষতার অভাব, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, ফ্রি ভিসার ফাঁদ, সিন্ডিকেট ও দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের পুরনো শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান কমেছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের। এছাড়া গত দুই বছরে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে কর্মী পাঠানোর হার। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় পুরনো শ্রমবাজার উন্মুক্ত এবং নতুন বাজার খোঁজার তৎপরতার কথা বললেও দৃশ্যত কোনো কাজ হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে জনশক্তি রফতানিতে বড় ধরনের ধস নামার আশঙ্কা করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটির) তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের গত ৯ মাসে ৪ লাখ ৭০ হাজার ২৬৫ জন কর্মী বিদেশ যেতে পেরেছে। যেখানে ২০১৮ সালের এই সময়ে সংখ্যাটি ছিল সাড়ে ৫ লাখ।
এর বিপরীতে গত দুই মাসে ফেরত আসা কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। যদিও বিএমইটি কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েও ফিরে আসাদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিটি প্রধান বাজারই বন্ধের পথে। যে পরিমাণ কর্মী নানা উপায়ে যেতে পারছে, তারাও সেখানে নানা প্রতিবন্ধকতায় টিকতে পারছেন না।
সৌদি আরব: বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রফতানির ৮০ ভাগই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। শ্রমশক্তি রফতানি করা দেশের মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সৌদি আরবে ১৫ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে। কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকসহ নানা সংকটে দেশটিতে বাড়ছে বেকারত্ব। নিজেদের বেকারত্ব ঘোঁচাতে বিদেশ থেকে কর্মী না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি সরকার। বরং দেশটিতে থাকা বাংলাদেশি শ্রমিকদের পুলিশি অভিযান চালিয়ে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে থাকা প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ৯ মাসে ১৮ হাজার শ্রমিক ফেরত পাঠিয়েছে সৌদি আরব সরকার।
সংযুক্ত আরব আমিরাত: কার্যত সাত বছর ধরে বন্ধ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শ্রমবাজার। স্বল্প পরিসরে খোলা থাকলে তা শুধু গৃহশ্রমিক খাতে সীমাবদ্ধ। যেখানে ২০১২ সাল পর্যন্ত বছরে আড়াই থেকে ৩ লাখ কর্মী পাঠানো হতো। এখন তা আড়াই হাজারে নেমেছে। চলতি বছরের নয় মাসে ২ হাজার ৪০৩ জন কর্মী পাঠানো গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। নানা দেন-দরবার করেও পুরুষ কর্মী পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার।
মালয়েশিয়া: বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রেখেছে। বছরে ৫ লাখ কর্মী নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে ২০১২ সালে ঘটা করে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল দুদেশের সরকার। চুক্তি অনুযায়ী ১৪ লাখের বেশি শ্রমিক দেশটিতে যেতে অনলাইনে নিবন্ধনও করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেট আর দালালদের দৌরাত্ম্যে ২০০ কর্মী পাঠিয়েই বন্ধ হয় সে কার্যক্রম। এরপর কয়েক দফা আলোচনা ও চুক্তি করেও সরকার উন্মুক্ত করতে পারেনি গুরুত্বপূর্ণ এই শ্রমবাজার। দুদেশের সরকার পরিবর্তনের পর এবার নতুন করে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
অন্যান্য: শ্রম রফতানি বন্ধ রয়েছে বাহরাইনেও। জর্ডান, লেবাননও সীমিত সংখ্যক কর্মী নিচ্ছে। মালদ্বীপ সরকার তার দেশে এক বছরের জন্য বাংলাদেশ থেকে কর্মী না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশ কাতার সরকারও কিছু দিন ধরে বাংলাদেশি কর্মীদের ভিসা ইস্যু করছে না। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা কাতারও যে কোনো সময় শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে।
সক্রিয় দালালচক্র: মধ্যপ্রাচ্যসহ শ্রমবাজারের এমন পরিস্থিতিতেও মানবপাচারকারী কিংবা দালালদের তৎপরতা বন্ধ নেই। এরমধ্যেও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, বাহরাইন, মালয়েশিয়াতে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে কর্মী পাঠাচ্ছে। আর এক মাস না যেতেই সর্বস্বান্ত হয়ে দেশে ফেরত আসতে হচ্ছে সেসব শ্রমিকদের। যে চিত্র প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে সৌদি আরবের ক্ষেত্রেও।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারক আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, দালালদের দৌরাত্ম্যে বৈধপথে শ্রমিক পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া সরকারের অসাধু কর্মকর্তারাও শ্রমবাজার সংকটে পড়ার জন্য দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি। তারওপরে রয়েছে সিন্ডিকেট।
যদিও এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকদের কারণেই শ্রমবাজার নতুন করে উন্মুক্ত করা যাচ্ছে না।
তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা শুধু পুরনো শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার আশায় বসে না থেকে এখন নতুন শ্রমবাজার খুঁজতে হবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ জালাল উদ্দীন শিকদার এ ক্ষেত্রে কুটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। নতুন শ্রমবাজার খুঁজতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তৎপরতায় ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কর্মী পাঠানোর ধরনেও পরিবর্তন আনতে হবে। ইউরোপ, রাশিয়া, জাপান, চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে দক্ষ জনশক্তি রফতানি কিভাবে করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন প্রকল্প প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, কয়েকটি কারণে শ্রমবাজারে ধস নামতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিনেও অভিবাসন ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা ও শ্রমিকদের দক্ষ করা যায়নি। শ্রমিক পাঠানো হয় সেই মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতে। শ্রমিক পাঠানোর আগে ন্যূনতম ধারণা দেওয়া হয় না। ফলে ওসব দেশের পরিবেশ, খাবার, আবহাওয়া ও আইন-কানুনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। শেষ পর্যন্ত কেউ ফেরে লাশ হয়ে, আবার বেশিরভাগ অভিবাসন ব্যয় তুলতে অবৈধ হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত আয় করতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ে অনেকে। এসব বিষয় সরকারকেই নজরদারিতে রাখতে হয়। যা কখনোই মানতে দেখা যায়নি।
আর অভিবাসন কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপের) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, সংখ্যার দিক থেকে কর্মী না পাঠিয়ে শ্রম রফতানিতে গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে কাজের ধরন প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। সেসবের সঙ্গে তাল মেলাতে শ্রমিকদের দক্ষ করে তুলে তারপর বিদেশে পাঠাতে হবে। মান্ধাতা আমলের চিন্তাধারার মতো শুধু অবকাঠামো খাতের চিন্তা করে জনশক্তি রফতানি বাড়ানো যাবে না। কর্মী পাঠানোর চিন্তা করতে হবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ ব্যাংকিং খাতেও। না হলে এ খাত ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে কথা হয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ জানান, সরকার এখন উচ্চমানের পেশায় কর্মী পাঠানোর চিন্তা করছে। এরইমধ্যে জাপানের সঙ্গে এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন। এছাড়া তিনি বলেন, চলতি মাসেই মালয়েলিয়া সফরে যাবেন, সেখানেও এ বিষয়ে কথা বলবেন।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে বিশ্বের ১৫৮টি দেশে জনশক্তি রফতানি করছে বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত ১ কোটি ২০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে কাজ নিয়ে গেছেন। বিদেশি শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখছে।
জনশক্তি প্রবাসী শ্রমিক বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়া শ্রমবাজার সৌদি আরব