সুশাসনের গুরুত্ব তুলে ধরে শেষ হলো অর্থনীতি সম্মেলন
২ নভেম্বর ২০১৯ ২০:১০
ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইকোনমিক্স স্টাডি সেন্টারের আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো ২য় বাংলাদেশ অর্থনীতি সম্মেলন। সম্মেলনে ছিল গবেষণাপত্র ও প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, সংলাপ, আলোচনা, বিতর্কসহ আরও নানা আয়োজন। এটির মিডিয়া পার্টনার ছিল সারাবাংলা ডটনেট।
২য় বাংলাদেশ অর্থনীতি সম্মেলন-২০১৯ এর প্রথম সংলাপের প্রতিপাদ্য ছিল: ‘বাংলাদেশে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রতিবন্ধকতা এবং এগিয়ে যাওয়ার উপায়।’
সংলাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজিম উদ্দীন খান বলেন, ‘অন্তত দশ বছরের জন্য উচ্চশিক্ষা বন্ধ করে দেওয়া উচিত।’ এ বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি এই মন্তব্য করে এর পেছনে মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশের অভাবকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, ‘উচ্চশিক্ষাকে গণশিক্ষায় পরিণত করা হচ্ছে।’ একই শ্রেণিকক্ষে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী থাকার কারণে শিক্ষকের পক্ষে সকল শিক্ষার্থীর প্রতি যত্নশীল হওয়া সম্ভব হয় না।
আলোচনা সভার অপর আলোচক টিচ ফর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মাইমুনা আহমেদ শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ করা অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে আলোচনা সভায় বলেন। অনেক দেশে জিডিপির চার থেকে ছয় শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকলেও বাংলাদেশে তা মাত্র দুই শতাংশে সীমাবদ্ধ।
সভার সভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফেরদৌসী নাহার আলোচনা সভা শেষ করেন এ বক্তব্যের সঙ্গে যে, ‘ভালো কিছু পেতে হলে ভালো কিছুর যোগান দিতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থার মান নিশ্চিত করতে চাইলে ‘ইনপুট’ হিসেবে শুধু টাকা নয়, বরং সঠিক মূল্যায়ন, ন্যায়পরায়ণতা এবং রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়গুলোও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
২য় সংলাপটির বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা-সুলভ ও সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা অর্জন’। সংলাপটির সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী।
সংলাপটিতে বক্তব্য রাখেন ডক্টর রশিদ ই মাহবুব, চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল হেলথ রাইটস মুভমেন্ট কমিটি, ডক্টর সৈয়দ আব্দুল হামিদ, প্রফেসর, ইনস্টিউট অফ হেলথ ইকোনোমিক্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ ইকবাল কবির, পরিচালক, প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসার্চ, ডিজিএইচএস
প্রথমেই বক্তব্য রাখেন ডক্টর সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি তার বক্তব্যে সুলভ ও সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের পথে অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক বাধাগুলো ব্যখ্যা করেন। তিনি বলেন যে দেশের ৬০% মানুষ এখনও স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করে ওষুধের দোকান বা অনভিজ্ঞ হাতুড়ে ডাক্তারের মাধ্যমে। ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ এবং ভাসমান মানুষদের আমরা স্বাস্থ্যসেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। যদিও উপজেলায় উপজেলায় কমিউনিটি ক্লিনিক আছে কিন্তু সেখানে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতালে ২১ জন ডাক্তারের পরিবর্তে থাকে ৩-৪ জন।’
সর্বশেষ সংলাপের সভাপতি ডক্টর মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী বলেন, ‘দেশে স্বাস্থ্যসেবার যোগানের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত না হলে ক্রমেই দেশের কর্মক্ষম জনশক্তি ও সম্পদ হ্রাস পাবে। তাই আমাদের অবশ্যই স্বাস্থ্যসেবাকে সুলভ এবং সাশ্রয়ী করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত হবে এবং আমাদের চিকিৎসকদের রোগের প্রাদুর্ভাব এবং রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।’
দ্বিতীয়দিনের আয়োজনে ছিল ৪টি প্যানেল আলোচনা। সম্মেলনের মূল উপপাদ্য ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই জীবিকা নির্বাহ নিশ্চিতকরণ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ কে মাথায় রেখেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন সব তথ্য উঠে আসে বিজ্ঞ আলোচক ও তরুণ দর্শকদের অংশগ্রহণমূলক আলোচনায়। দ্বিতীয়দিনের ৩য় সেশনে ‘বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রচার: প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনাটি সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক সাদেকা হালিম। আলোচক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড সায়েমা হক বিদিশা। আরও ছিলেন ‘ইকুয়ালিটি ও ইউথ এমপাওয়ারমেন্ট,ইয়ুক্তা’ এর কনসালটেন্ট হাবিবুর রহমান ও ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এর জেন্ডার অ্যাডভাইজর উম্মে সালমা।
সেশনের শুরুতেই সভাপতি আলোচকদের কাছে দিনদিন নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারের নিম্নগতি, মেয়ে শিশুদের স্কুলে তুলনামূলক বেশি অংশগ্রহণ হওয়া সত্ত্বেও শ্রম বাজারে তাদের কম অংশগ্রহণ, নারীদের বাড়ির বাইরে কাজ করার বিষয়ে পরিবার ও সমাজের কিছুটা সংকীর্ণ মানসিকতা, বাজেটে নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত অংশ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেন।
প্রথমেই সায়েমা হক বিদিশা আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘নারীদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন মানেই ঠিক ক্ষমতায়ন না। কেননা বেশির ভাগ নারীই যুক্ত আছে কম বেতনের ও আনপেইড কাজগুলোয়। কেবল ১২% নারী রয়েছেন ম্যানেজারিয়াল পজিশনে। এ ছাড়াও একটি বড় অংশ তাদের সময় দিচ্ছেন অবৈতনিক গৃহস্থালির কাজে যেটি কখনোই জিডিপিতে যোগ করা হয় না।’
অনুষ্ঠানের শেষে তরুণ দর্শকদের প্রশ্নে উঠে আসে রেমিটেন্স প্রদানকারী নারীদের বিদেশে নানা ধরনের নির্যাতন এর উদহারণ ইত্যাদি।
অধ্যাপক সাদেক হালিম তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই শুধু তার ক্ষমতায়ন হতে পারে না। নারী ক্ষমতায়ন বলতে আমি তার রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং তার ব্যক্তি মানুষের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা কে বুঝি।’
২য় বাংলাদেশ অর্থনীতি সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য: সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য হুমকি’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনাটি।
আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও ইকোনমিক্স স্টাডি সেন্টারের মডারেটর ড. এম এম আকাশ।
আলোচনায় আরো অংশ নেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ– সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট-এর নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফা কে. মুজেরি, এবং বাংলাদেশ ব্যাংক-এর সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ।
আলোচনার শুরুতে ড. এম এম আকাশ অতীতের উদাহরণ টেনে বলেন একসময় পুঁজিপতিদের হাতে আরো পুঁজি দেয়াকে যৌক্তিক মনে করা হত কেননা ভাবা হত তারা সেই অর্থ পুনর্বিনিয়োগ করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে যা বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে। তবে বর্তমানে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে বৈষম্য কমাতে জনসংখ্যার নিচের ৪০ ভাগ মানুষের অগ্রগতি উপরের ১০ ভাগের অগ্রগতির চেয়ে ত্বরান্বিত করতে হবে।
ড. আকাশ আরো বলেন, বৈষম্য যে অর্থনীতির জন্য খারাপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু এর থেকে উত্তরণের উপায়গুলোকে বের করতে হবে।
পরবর্তী বক্তা ড. মুস্তাফিজুর রহমান ইএসসিকে ধন্যবাদ জানান একটি সময়পোযোগী বিষয়ের উপর আলোচনা আয়োজন করার জন্য। তিনি বলেন বৈষম্যের মত গুরুত্বপূর্ন ও জটিল বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
এরপর ড. মুস্তাফা কে. মুজেরি বলেন স্বাধীনতার পর আমাদের সকল সামাজিক সূচকেই ৩ গুণেরও বেশি অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু গড় সূচক সমূহ আমাদের পূর্ণ চিত্র দেখায় না। বিদ্যমান বৈষম্য অদৃশ্যই থেকে যায়।
তিনি বলেন স্বাধীনতার পর বর্তমানে আমরা উন্নয়নের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছি। একই সাথে বৈষম্যও পৌঁছেছে তার সর্বোচ্চ মাত্রায়। অর্থনৈতিক বৈষম্য হল অসম সু্যোগ বণ্টনের ফল। দরিদ্র ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অসমভাবে সুযোগ বণ্টন হয়েছে কাঠামোগত ও নীতিগত দুঃশাসনের ফলে।
বাংলাদেশ ব্যাংক-এর সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ তার বক্তব্যের শুরুতে বলেন যে নানা রকম অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও হতদরিদ্ররা আগের মতই কষ্ট সহ্য করে। যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম বৈষম্য থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, সেখানে এখনো বৈষম্য বিদ্যমান। উন্নয়ন আগে, সুষম বন্টন পরে-এই নীতির ফলে বণ্টনকারী-নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতির কারণে বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে যা অত্যন্ত হতাশাজনক। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক্স স্টাডি সেন্টারের আয়োজনে তিনদিন ব্যাপী চলা এই অনুষ্ঠানটি ৩১শে অক্টোবর শুরু হয়ে শেষ হয় ২রা নভেম্বরের সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
এতে সমাপনী বক্তব্য দেন ইএসসির মডারেটর ড. এম এম আকাশ। তিনি বলেন, ‘এ সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা একটা জিনিস দেখতে পেয়েছি বাংলাদেশে আমাদের আগামী যেই সমস্যাটি প্রকট সেটি হল সুশাসন। আমরা মনে করি এই সম্মেলনের মাধ্যমে এটি ইএসসির একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাদের অভিনন্দন জানাই।’
প্রধান অতিথি ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার গুনগত মানের পরিচয় দেয়। ইএসসি সেইদিক থেকে গুণগত সক্রিয়তার পরিচয় দেয়। আমাদের চিন্তা ভাবনার একটি ক্ষেত্র তৈরির দিকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা সবসময় এদেশের পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়েছে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে। আমাদের আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে যেন আমরা এখানে বসেই আলোচনা করতে পারি। বৈশ্বিক অবস্থানে অবদান রাখতে পারি।’ অনুষ্ঠানের শেষাংশে বিশেষ অতিথিরা প্রধান অতিথির হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন।