রাইড শেয়ারিং: তালিকাভুক্ত করেই দায় সেরেছে বিআরটিএ
৪ নভেম্বর ২০১৯ ০৯:১৩
ঢাকা: দেশে তিন বছর ধরে চলছে অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা। কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এই সেবার বিস্তার ঘটেছে। তবে গত বছর থেকে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধনের জন্য চাপ দিতে থাকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। ফলে বাধ্য হয়েই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্প্রতি তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করে। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত ১২টি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করেছে বিআরটিএ।
জানা গেছে, রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে শুধু ‘এনলিস্টমেন্ট’ সাটিফিকিকেট দিয়ে বা তালিকাভুক্ত করেই দায় সেরেছে বিআরটিএ। এ খাতে শৃঙ্খলা আনতে কোনো উদ্যোগ নেই সড়ক পরিবহন খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার। নীতিমালা প্রণয়ণের তিন বছরে কেবল এটুকুই তাদের অর্জন।
রাইড শেয়ারিংয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, তালিকাভুক্তির পর নিবন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদনের কথা রয়েছে কোম্পানিগুলোর। সেক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান আবেদন জমা দিয়েছে বলে জানা গেছে। ২০১৮ সালের ৮ মার্চ নীতিমালা কার্যকরের গেজেট প্রকাশ হলেও গেল ২০ মাসে তা হয়নি। কেবলমাত্র ২০১৯ সালের ৪ আগস্ট ১২টি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করেই দায় সেরেছে বিআরটিএ।
বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ে রাইড শেয়ারিংয়ের আলাদা সেল রয়েছে। এই সেলে পাঁচজন কর্মকর্তা রয়েছেন। কোম্পানি তালিকাভুক্তি ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি তারা। অবশ্য কর্মকর্তাদের দাবি, তারা উপর থেকে কোনো নির্দেশনা পাননি।
নীতিমালা অনুযায়ী, রাইড শেয়ারিং মোটরযানের কোনো তালিকা বা মোটরযানগুলোর অ্যানলিস্টমেন্ট করা হয়নি। শুধু কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে নীতিমালায় নির্ধারিত কয়েকটি মোটরযানের তথ্য দিয়েই ‘এনলিস্টমেন্ট’ সার্টিফিকেট নিয়েছে ১২টি প্রতিষ্ঠান। তবে বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার মোটরযান চলছে; যেগুলোর ‘এনলিস্টমেন্ট’ সাটিফিকিকেট নেই। এভাবে নীতিমালার শর্ত লঙ্ঘন করেই চলছে রাইড শেয়ারিং বাণিজ্য।
সম্প্রতি বিআরটিএ-তে যোগ দেওয়া নতুন চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান জানান, তিনি বিআরটিএ সব কাজে স্বচ্ছতা আনতে একে একে বৈঠক করছেন। রাইড শেয়ারিং নীতিমালা প্রণয়ণের সঙ্গে তিনি নিজে জড়িত ছিলেন জানিয়ে বলেন, ‘নীতিমালার বিষয়গুলো নিয়ে সেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবশ্যই বসব।’
বিআরটি-এর তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- উবার, পাঠাও, সহজ, ওভাই, পিকমি, সিএনএস, চালডাল, ইজিয়ার, আকাশ, সেজেস্টো, বাডি, আকিজ। এই ১২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম চারটির রাইডশেয়ারিংয়ে দেখা যায়। বাকিদের রয়েছে শুধু এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট। বাস্তবে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই।
এদিকে উবার পাঠাও ও সহজ-এর বিরুদ্ধে প্রতিদিন শত শত অভিযোগ ও এখন পর্যন্ত একটিরও ব্যবস্থা নেয়নি বিআরটিএ। অভিযোগ যাচাইয়ের কারিগরি ক্ষমতা বিআরটিএর হাতে ছাড়েনি রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো। যা নীতিমালার লঙ্ঘন।
নীতিমালায় ১১ নম্বর শর্তানুযায়ী, সব রাইডশেয়ারিং মোটরযানের তালিকা বিআরটিএর ওয়েবসাইটে রাখার কথা বলা হলেও তা নেই। মোটরযানের এনলিস্টমেন্ট ছাড়া কোনো গাড়ি দিয়ে রাইডশেয়ারিং করা যাবে না এমন শর্ত অনুচ্ছেদ ঘ-এর ১ নম্বর শর্তে থাকলেও একটি মোটরযানের এনলিস্টমেন্টও বিআরটিএর ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি।
প্রায় দুই বছর আগে নীতিমালা কার্যকরের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত তা না হওয়ায় এই খাত থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। রাইড শেয়ারিংয়ের প্রতিটি গাড়ির এনলিস্টমেন্ট বাবদ প্রতি বছর একটি মোটরসাইকেলে পাঁচশ ও মোটরযানে এক হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তা পায়নি।
বিআরটিএর ওয়েবসাইটে দেওয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মোটরসাইকেল। আর কেবলমাত্র ঢাকায়ই এর সংখ্যা সাত লাখের উপরে। যেখানে আগে বছরে মোটরসাইকেল নিবন্ধনের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের নিচে, সেখানে রাইড শেয়ারিং শুরুর পর বছরে এই সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
এদিকে রাইড শেয়ারিংয়ের যাত্রীদের বহু অভিযোগ প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। কোনোভাবেই এসব অভিযোগের সমাধান মিলছে না বলে জানাচ্ছেন যাত্রীরা। বনানী থেকে প্রতিদিন অফিস শেষে বিকেল পাঁচটার দিকে রামপুরার বাসায় ফেরেন আতিয়া শারমিন। এ সময় উবারে মাত্র ৮ কিলোমিটারের ভাড়া দেখায় পাঁচশ টাকা বা তার বেশি। অন্য সময় দুইশ থেকে আড়াইশ টাকার ভেতর থাকে। তার অভিযোগ, পিক আওয়ারে অর্থাৎ অফিস শুরু ও শেষের সময় উবার ভাড়া বাড়িয়ে নেয়।
এ বিষয়ে উবার অ্যাপে বলা হয়, যাত্রী চাপ বেশি থাকায় ভাড়া বেশি। উবার চালকদের সংগঠন রাইড শেয়ারিং ড্রাইভার্স ইউনিয়ন নেতা শামীম আহমদ বলেন, ‘তারা সম্প্রতি উবারের বিরুদ্ধে যে কর্মবিরতি পালন করেছেন সেখানেও যাত্রী স্বার্থের এই বিষয়টিও ছিল। অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের পকেট কাটে উবার। ট্রিপ শেষে যাত্রীরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন।’
গত ১২ অক্টোবর রাতে উবারে কারে বাসায় ফেরেন ফয়সাল হাসান। এ সময় পাঁচশ টাকার ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে এক হাজার টাকার নোট দিলে সেটা নিয়ে পালিয়ে যায় চালক। এ বিষয়ে অ্যাপে অভিযোগ দিয়ে সমাধান পাননি তিনি। তাৎক্ষণিক উবারের কোনো হেল্পলাইন নম্বরও পাননি। যদিও নীতিমালায় রয়েছে, এসব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন নম্বর খোলা রাখতে হবে।
নীতিমালায় আরও বলা আছে, রাইড শেয়ারিংয়ের ভাড়া ট্যাক্সিক্যাবের চেয়ে বেশি হতে পারবে না। বাস্তবে উবার যাত্রী চাপ দেখে ভাড়া কখনও কখনও অস্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে যাত্রীর চাহিদা বেড়ে গেলেই উবার পরিকল্পিতভাবে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়।
নীতিমালার অনুচ্ছেদ চ অনুযায়ী, রাইডশেয়ারিং নিয়ে একটি ওয়েবপোর্টাল থাকবে; যেখানে সব কোম্পানির ‘সিকিউরিটি সিস্টেম’ ও ‘পাসওয়াড’ বিআরটির কাছে দিয়ে রাখবে। যা এখনও করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে পাঠাও-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট কিশোয়ার হাশমি’র মোবাইল ফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। ফোন ধরেননি প্রতিষ্ঠানটির বিপণন কর্মকর্তা নাবিলা মাহবুব। এছাড়া উবার বাংলাদেশের প্রধান জুলকার নাইনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে পাঠাও-এর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, বিআরটিএ থেকে তারা এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট নিয়েছেন। এর বাইরে সেখান থেকে কোনো নির্দেশনা তাদের কাছে নেই। আর নিরাপত্তা ও পাসওয়ার্ড সংক্রান্ত তথ্য বিআরটিএর কাছে দিতে চাচ্ছেন না তারা।
রাইড শেয়ারিং নীতিমালা কার্যকর করতে পর্যালোচনা কমিটি করে কয়েকটি বৈঠক করেছিল বিআরটিএ। সেই কমিটির সদস্য ছিলেন বুয়েটের অধ্যাপক গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘রাইড শেয়ারিং যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কথা সেভাবে হয়নি। এ জায়গায় দুর্বলতা দেখেছি। এ ধরনের সেবা প্রথমদিকে পরিচিত ও জনপ্রিয় হতে থাকে। তবে পরে একটা সময় এগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সেই সময় এখন যাচ্ছে। কিন্তু যেভাবে নিয়ন্ত্রণ বা নীতিমালা কার্যকর করার কথা সেভাবে হচ্ছে না।‘
তিনি আরও বলেন, ‘কোম্পানিগুলো কোনো অপরাধ ঘটিয়ে যেন পার পেয়ে না যায় সেজন্য তাদেরকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। এতে তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ কম থাকবে।’