শিশু আয়েশার হত্যা মামলার চার্জশিট যেকোনো সময় আদালতে
৫ নভেম্বর ২০১৯ ০৯:১৮
ঢাকা: আসছে ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে তিন বছর পূর্ণ হতো শিশু আয়েশার। রাজধানীর গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের ৫৩/১/ছ নম্বর চার তলা বাড়ির পাশে টিনশেড বস্তিতে মা-বাবার সঙ্গে থাকত সে। এ বছরের ৫ জানুয়ারি ওই চার তলা বাড়ির সামনে তার নিথর রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করা হয়। হত্যার প্রায় ১০ মাস পর শিশুটির হত্যা মামলার চার্জশিট প্রস্তুত হয়েছে। গ্রেফতার একমাত্র আসামি নাহিদ হোসেনকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করে চার্জশিটটি যেকানো সময় দাখিল হতে পারে আদালতে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই’র উপপুলিশ পরিদর্শক সাদেকুর রহমান মোবাইল ফোনে সারাবাংলাকে জানান, মামলাটি তদন্ত শেষে এরই মধ্যে চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে। একমাত্র আসামি নাহিদ হোসেনকে অভিযুক্ত করে তৈরি করা চার্জশিট আদালতের উদ্দেশে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানোও হয়েছে। যেকোনো সময় চার্জশিট আদালতে পৌঁছে যাবে। চার্জশিটে আসামির বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের জিআরও শাখার কর্মকর্তা জানান, যেহেতু মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিট তৈরি করে আদালতের উদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাই যেকোনো মুহূর্তে চার্জশিট আদালতে আসতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত মামলার চার্জশিট আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়ানি। এজন্য ঢাকার সিএমএম আদালত মামলাটির পরবর্তী প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৮ ডিসেম্বর দিন নির্ধারণ করেছেন।
দীননাথ সেন রোডের ওই বস্তিতে মা-বাবা ও তিন বোনের সঙ্গে থাকত শিশু আয়েশা। অন্যান্য দিনের মতো ৫ জানুয়ারি বিকেলেও সে খেলতে বের হয়। সন্ধ্যার দিকে টিনশেড বস্তির পাশের চার তলা বাড়ির সামনে আয়েশার রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। দ্রুত আয়েশাকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শিশু আয়েশার মা রাজিয়া সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, মেয়েকে হত্যার প্রায় ১০ মাস হয়ে গেছে। মেয়ে বেঁচে থাকলে আগামী ১৩ ডিসেম্বর ওর তৃতীয় জন্মবার্ষিকী পালন করতে পারতাম। এখন জানুয়ারিতে ওর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে হবে।
রাজিয়া সুলতানা বলেন, যত সময় গড়ছে, ততই আমরা ভেঙে পড়ছি। আমি কি আর আমার মেয়ের বিচার পাব না? অন্যান্য মামলায় যে আলোচিত ঘটনাগুলো ঘটেছিল, তাদের তো অনেক দ্রুত বিচার হয়েছে। কিন্তু আমার মেয়ের বিচার তো শুরুই হলো না!
এর মধ্যে নানা ধরনের অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন বলেও জানান আয়েশার মা। তিনি বলেন, মানুষেরা বলাবলি করে, আমরা নাকি আসামিদের সঙ্গে আপস-মীমাংসা করে ফেলেছি৷ কেউ বলে ৫ লাখ টাকা ও ফ্ল্যাট নিয়ে নাকি আমরা মীমাংসা করছি। কিন্তু মেয়েকে কি বিক্রি করা যায়! কিছুদিন আগে একজন এসে আমাকে বলছে, আসামি নাকি ছাড়া পেয়েছে, বাজারের দেখা গেছে। এ ধরনের কথাবার্তা শুনলে বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে খানখান হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ে যেখানে মারা গেছে, প্রতিদিনই সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, কান্নাকাটি করি। এখনো বিশ্বাস হয় না, মেয়ে আমার বেঁচে নেই। প্রতিদিন মেয়েকে খুঁজে বেড়াই। সব মেয়েকে দেখি, আমার মেয়েটা নেই।
অবশ্য মামলার চার্জশিট প্রস্তুতির খবর পেয়েছেন রাজিয়া। এ জন্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আমাকে কল দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, চার্জশিট তৈরি করে আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। উনি আমার মেয়ের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন।
আয়েশার বাবা মো. ইদ্রিস বলেন, আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। কয়েকদিন আগেই শুনেছি, মামলার আইও নাকি চার্জশিট আদালত পাঠিয়েছেন। আমি আসামির সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসি চাই। তবেই আমার মেয়ের আত্ম শান্তি পাবে।
আয়েশার হত্যার ঘটনায় পরদিন ৬ জানুয়ারি তার বাবা ইদ্রিস বাদী হয়ে গেন্ডারিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় নাহিদকে গ্রেফতারের দাবিতে এলাকাবাসী গেন্ডারিয়া থানা ঘেরাও করে ও এলাকায় বিক্ষোভ মিছিলও করে।
মামলাটি দায়েরের পর নাহিদকে গ্রেফতারে সচেষ্ট হয় পুলিশ। তবে গ্রেফতার হওয়ার আগে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে নাহিদ বাসার তৃতীয় তলার খোলা জানালা দিয়ে লাফ দেয়। এতে তার দুই পা ভেঙে যায়। এরপরে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসা শেষে পুলিশ তাকে রিমান্ডে নেয়। রিমান্ড চলাকালে নাহিদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় গেন্ডারিয়া থানা পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নাহিদ জবানবন্দি দিতে অস্বীকৃতি জানালে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
গেন্ডারিয়া থানা পুলিশের প্রতি আস্থা রাখতে পারেননি আয়েশার পরিবার। গত ৫ মার্চ আইনজীবীর মাধ্যমে গেন্ডারিয়া থানা কর্তৃপক্ষের পরিবর্তে অন্য কোনো তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে মামলাটি তদন্ত করার আবেদন করেন আয়েশার বাবা।
আবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি নাহিদকে পাঁচ দিনের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয় পুলিশ। চার দিনের রিমান্ড চলাকালে নাহিদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হয়। কিন্ত পরে তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। যার ফলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা আর কোনো পদক্ষেপ নেননি। এ জন্য অন্য তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করার আবেদন মঞ্জুর করার প্রার্থনা করা হয়।
পরে চলতি বছরের ৮ এপ্রিল নাহিদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পিবিআই। আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে ২৫ এপ্রিল তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর থেকে নাহিদ কারাগারেই রয়েছে। নাহিদের পক্ষের আইনজীবীরা কয়েকবার জামিন আবেদন করলে তা নামঞ্জুর করে আদালত।
জানা যায়, আসামি নাহিদের স্ত্রী ৫ বছর আগে মারা যায়। এরপর আর বিয়ে করেনি সে। ১২ বছরের মেয়েকে নিয়ে ওই বাসায় থাকে নাহিদ।