বহরপুরের শান্তি মিশন থেকে ঔষধি উদ্ভিদের প্রাকৃতিক জিনব্যাংক
৫ নভেম্বর ২০১৯ ১১:০৭
রাজবাড়ী: জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর গ্রামের ড. এম এ হাকিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে বেছে নিয়েছিলেন ঔষধি গাছ নিয়ে গবেষণা। দীর্ঘদিন পর ১৯৮২ সালে বাড়ির পাশে ছোট পরিসরে শুরু করেন ঔষধি গাছের বাগান। নাম দেন শান্তি মিশন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে শান্তি মিশনের পরিধি। বর্তমানে ৪৩ একর জমি জুড়ে রয়েছে তার শান্তি মিশন। সেই শান্তি মিশনই এখান বাংলাদেশের ঔষধি উদ্ভিদের একমাত্র প্রাকৃতিক জিনব্যাংক। এম এ হাকিমের দাবি, এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারত উপমহাদেশের মধ্যেও একমাত্র জিনব্যাংক।
ড. এম এ হাকিম নিম গাছের পাতায় তৈরি প্রসাধনী ও ঔষধ উদ্ভাবন করে দেশ-বিদেশে সমাদৃত হয়েছেন ড. নিম হাকিম নামে। এ নামেই পরিচিত তিনি। ড. হাকিম বলেন, ‘আমি শান্তির মিশনের কার্যক্রম শুরু করি ১৯৮২ সালে। প্রথমে শুরু করা হয় দুই একর ১৬ শতাংশ জমির ওপর। পরে আস্তে আস্তে নিজের অর্জিত অর্থ দিয়ে ৪৩ একর জামির উপর গড়ে তুলি ঔষধি উদ্ভিদের বিশাল এই জিন ব্যাংক।
‘এটা করার সময় আমার একটা চিন্তা ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি যে ঔষধি গাছগুলো চিনতাম এবং দেখতাম সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই বিলুপ্ত হওয়ার কারণে বাংলাদেশে ইউনানি আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথি কারাখানায় তারা যে ঔষধ তৈরি করছে তা খেয়ে মানুষের তেমন কোন কাজ হচ্ছে না। সেই চিন্তা থেকেই আমি এখানে আস্তে আস্তে ঔষধি উদ্ভিদের জিনব্যাংক গড়ে তুলি’, বলেন এই গবেষক।
তিনি বলেন, ‘রোজেলা, নিম, নিসিন্দা, লজ্জাবতী, মহুয়া, হরতকি, আমলকিসহ ৬৯৭ প্রজাতির ঔষধি গাছ রয়েছে এখানে। আর ঔষধি, ফলজ ও বনজ মিলিয়ে মোট গাছ রয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৬১ প্রজাতির। রয়েছে জংলী পান, শঙ্খচূড়া, লাল তুলশি, তালি পাম, ননি, নীল আদা, রবিনসন বার্লিসহ পৃথিবীর অনেক বিলুপ্ত ও বিরল প্রজাতির গাছও। আমরা এখানে মা গাছ তৈরি করি। এখান থেকে বীজ কাটি, আমরা গ্রামের নারীদের প্রশিক্ষণ দেই।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মেডিসিনাল প্লান্টস অ্যান্ড হারবাল প্রোডাক্টস বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল থেকে এই প্রশিক্ষণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এগুলো দিয়েই আমরা আস্তে আস্তে সারা বাংলাদেশেই ভেষজ ঔষধি উদ্ভিদের অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাত করার কাজ শুরু করেছি।’
এই বাগানের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা ও দরিদ্র মানুষের চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি বেকারদের কাজের ব্যবস্থাও তৈরি করেছেন ড. নিম হাকিম। তার বাগানে উৎপাদিত ঔষধি গাছ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার প্রসাধনসামগ্রী ও ফাংশনাল ফুড তৈরি করে রফতানি করা হচ্ছে সৌদি আরব, মিসর, জাপান, কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায়।
ড. নিম হাকিম বলেন, ‘আমরা শুধু এখানে এই উদ্ভিদ দিয়ে প্রসাধনী ও ফাংশনাল ফুড বা ঔষধ তৈরি করছি তা নয়। আমার স্বপ্ন আছে, এই ঔষধি যারা তৈরি করবে এবং যারা এই ঔষধির জন্য মানুষকে প্রেসক্রিপশন করবে তাদের জন্য শান্তি মিশনের ভিতরেই আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় করার। যার নাম হবে ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি অব ন্যাচারাল মেডিসিন। একই সঙ্গে গবেষণার সুবিধার্থে আমরা এখানে একটা আন্তর্জাতিক ভেষজ গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করবো। আমরা ইতোমধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভেষজ গবেষণাগারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কপিরাইট পেয়েছি। খুব শিগগিরই এখানে কাজ শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে শুধু বাংলাদেশই নয় ভারত উপমহাদেশেও এমন জিনব্যাংক নেই। এটা নিয়ে কেউ চিন্তাও করে না। মানুষ ধানের জিন, গমের জিনসহ নানা রকমের জিনব্যাংক বানাচ্ছে। কিন্তু মানুষের যেটা উপকারী, যেটা দিয়ে মানুষের ঔষধ হয়, যেটা দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা পায়, সেই জিনিস নিয়ে কেউ কাজ করছে না। মানুষ যেটি করে না, আমি সেটি করতে চাই।’
ড. নিম হাকিমের এই শান্তি মিশনে দেশের একমাত্র ‘ইকো পন্ড’ও রয়েছে। যেখানে বিলুপ্তপ্রায় দেশি প্রাণিরা অবাধে বিচরণ করে থাকে বলেও জানান তিনি।