আলজেরিয়ায় ২২ শ্রমিকের মানবেতর জীবন, ভিডিওবার্তায় ফেরার আকুতি
১১ নভেম্বর ২০১৯ ০৯:৫০
ঢাকা: ভালো কাজ, কম পরিশ্রমে উচ্চ বেতনের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল সুমন, দেলওয়ার, মোহসিন ও হেলালদের। বলা হয়েছিল পৌঁছে দেওয়া হবে আটলান্টিক মহাসাগর তীরের দেশ স্পেনে। আর সেই স্বপ্নের দেশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পার হতে হবে আরও দুটি দেশ। প্রথমে উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়া, পরে মরক্কো হয়ে তারপর স্পেন। রিক্রুটিং এজেন্সির দেখানো এমন স্বপ্নে বিভোর হয়ে, প্রলোভনে পড়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্পেনের পথে।
রিক্রুটিং এজেন্সি নামধারী মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে আলজেরিয়া ও মরক্কোতে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে এইসব প্রতারিত শ্রমিকদের।
আলজেরিয়ায় আটকা পড়ে পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের কাছে ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন এমন ২২ হতভাগ্য শ্রমিক। ভিডিওবার্তায় জানিয়েছেন তাদের কষ্টের কথা। তারা আরও জানিয়েছেন, রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছিল তা সবই মিথ্যা।
আলজেরিয়াতে কাজের সুযোগ খুব একটা না থাকায় সামান্য বেতনে কাজ করে কোনোরকম বেঁচে আছেন। তাই ভিডিও বার্তায় স্বজনদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন দেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে।
এসব শ্রমিকের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভালো বেতনে কাজের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে বিদেশ যেতে রাজি করিয়েছিল রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। আর এর জন্য মানবপাচারকারীরা নিয়েছিল নানা কৌশল। রিক্রুটিং এজেন্সির কার্যালয়গুলোতে রাখা ছিল বিশ্ব মানচিত্র। সে মানচিত্র ধরে ধরে দেখানো হতো বাংলাদেশ থেকে আলজেরিয়া, আর আলজেরিয়া থেকে মরক্কো এবং সেখান থেকে স্পেনের দূরত্ব।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অনুসন্ধান করে জানা গেছে, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ছাড়পত্র নিয়েই এমন প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কর্মী পাঠাচ্ছে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি। তাদের পাঠানো অধিকাংশ শ্রমিকই প্রতারিত হচ্ছেন বিদেশে গিয়ে। গেল কয়েকমাস আগে আলজেরিয়া থেকেই দেশে ফিরেছেন ৯ জন ভাগ্য বিড়ম্বিত কর্মী।
সারাবাংলা প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তাদের একজন মোহাম্মদ ফারুখের সঙ্গে। তিনি জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিত ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে মুন্সিগঞ্জ ও এর আশেপাশের এলাকার ৫৬ জন কর্মীকে আলজেরিয়া-মরক্কো হয়ে স্পেনে পাঠানোর উদ্দেশ্যে পাঠায় রিক্রুটিং এজেন্সি বন্যা বিজয় ওভারসিজ লিমিটেড (আরএল-১৩১৪) এবং সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেইনিং সেন্টার। আলজেরিয়া যাবার আগেই এই ট্রেইনিং সেন্টার থেকে বলে দেয়, তারা চাইলে আলজেরিয়াতে কাজ করতে পারবে। ভালো না লাগলে মরক্কো হয়ে স্পেনেও চলে যেতে পারবে।
ফারুক জানান, বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। আলজেরিয়াতে কাজের সুযোগ কম, কাজ পেলেও বেতন খুবই কম। নয় জন সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন, স্পেনে রওনা হয়ে মরক্কোতে আটকা পড়েছে আরও চার জন। এছাড়া আলজেরিয়ায় অবস্থান করছেন আরও ৪২ বাংলাদেশি।
দেশে ফিরে এসব কর্মীরা রিক্রুটিং এজেন্সি বন্যা বিজয় ওভারাসিজ লিমিটেড ও সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেইনিং সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তাদের উল্টো হুমকি দিচ্ছে বলেও জানান তারা।
এর আগে গত জুলাই মাসে মরক্কো থেকে দেশে ফেরত আসা দুই কর্মী রায়হান ও মো. ওমর ফারুক জানান, ২০১৭ সাথে রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স আরএস লিংকার্স (আরআল-৯৬) তাদেরকে জনশক্তি ব্যুরোর ছাড়পত্র দিয়ে আলজেরিয়া পাঠান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তারা মরক্কো হয়ে স্পেন যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি।
এভাবে আলজেরিয়া থেকে মরক্কো হয়ে স্পেন যাবার উদ্দেশ্যে ব্যর্থ হয়ে মরক্কো থেকে দেশে ফেরত আসেন মো. মিজানুর রহমান, মো. মহিউদ্দিন ও মো. রায়হান।
এ প্রসঙ্গে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এসেছে। তবে তথ্য-প্রমাণ এবং অভিযোগ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
স্বজনদের কাছে পাঠানো ভিডিও বার্তায় আলজেরিয়ায় থেকে সুমন জানান, তাদের সঙ্গে হওয়া প্রতারণার কথা। বলেন, ৪ শ থেকে ৫ শ ডলার বেতন আর আট ঘণ্টা ডিউটির সঙ্গে ২ ঘণ্টা ওভার টাইমের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল রিক্রুটিং এজেন্সি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেখানে তাদের প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। বেতন হয় তিনমাস পর এক মাসের। ঠিকমতো থাকা-খাওয়াও জুটছেন না। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ফেরানোর জন্য আকৃতি জানিয়েছেন স্বজনদের কাছে। সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও। তারা বলছেন, তাদেরকে কাজের উদ্দেশ্যে নয়, মূলত পাচার করা হয়েছে। এই পাচার বন্ধে সরকারের সহযোগিতা চান এইসব প্রবাসী শ্রমিকেরা।
এসব ভিডিও বার্তার পর সাত জন শ্রমিকের পরিবার বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের কাছে আবেদন জানায় তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থাণ মন্ত্রণালয়েন অধীনে থাকা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করে ব্র্যাক। গত ৯ অক্টোবর ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠান। বোর্ড বিষয়টি আমলে নিয়ে আলজেরিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসকে চিঠি দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ওয়েস আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাস জানান, আলজেরিয়াতে থাকা শ্রমিকদের ফেরত আনতে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘আলজেরিয়াতে আটকে পড়া সাত জনের পরিবার আমাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। আলজেরিয়াতে অবস্থানরত ওই বাংলাদেশিদের নিরাপদে দ্রুত দেশে ফেরত আনতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডকে গত ৯ অক্টোবর আমরা লিখিতভাবে আবেদন করেছি। বোর্ড থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসে। তবে সার্বিক ঘটনা শুনে আমাদের মনে হচ্ছে, স্পেনে পাঠানোর স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের পাঠানো হচ্ছে। বিষয়টা উদ্বেগজনক। আশা করছি সেখানকার দূতাবাস থেকে সরকারকে এ ব্যাপারে করণীয় জানানো হবে। দ্রুত এই ধরনের প্রতারণা বন্ধ করতে না পারলে আরও অনেককে বিপদে পড়তে হবে। দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হবে। আশা করি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’