ঢাকা শিশু হাসপাতালের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা উধাও
১১ নভেম্বর ২০১৯ ১৬:০৭
ঢাকা: ঢাকা শিশু হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের (সিপিএ ফান্ড) টাকা লোপাট হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্য অর্থ বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্বেই নিয়োজিত হাসপাতালের উপ-পরিচালক (অর্থ) শাহ আলম মিয়া ও সহকারী পরিচালক (উন্নয়ন) নেছার উদ্দিনের বিরুদ্ধে।
শুধু তাই নয়, ভুয়া ভাউচার তৈরি করেও হাসপাতাল থেকে টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে এই দুজনের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি হাসপাতালটির প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকার হিসাবে গরমিল দেখা দেওয়ার অভিযোগ উঠলে তা খতিয়ে দেখতে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদন ও ভাউচারের একাধিক কপি সারাবাংলার হাতে রয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, সহকারী পরিচালক (উন্নয়ন) নেছার উদ্দিন ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমা দেখিয়েছেন ১০ লাখ ৭৬ হাজার ৫২ টাকা। অডিট রিপোর্টেও টাকার অঙ্ক রয়েছে একই। অথচ তদন্ত প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন ১০ লাখ ১৬ হাজার ৫৮১ টাকা। অর্থাৎ এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫৯ হাজার ৪৭১ টাকা আত্মসাৎ করেছেন নেছার উদ্দিন।
প্রতিবেদনের অন্য একটি নথিতে দেখা যায়, শিশু হাসপাতালের উপপরিচালক (অর্থ) শাহ আলম মিয়া ২০০৪/০৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-০৮ অর্থবছর পর্যন্ত ৪২ লাখ ৫৩ হাজার ৯৫০ টাকা জমা দেখিয়েছেন। অডিট রিপোর্টেও একই টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তদন্ত কমিটির হিসাবে দেখা যায়, টাকার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৪১ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৬ টাকা। অর্থাৎ এই নথি অনুযায়ী ৬৪ হাজার ৪২৪ টাকা আত্মসাৎ করেছেন শাহ আলম মিয়া।
অন্য এক শিটে দেখা যায়, সাবেক ক্যাশিয়ার ইদ্রিস আলী ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত জমা টাকার পরিমাণ উল্লেখ করেছেন ৯ লাখ ১৯ হাজার ৭৭৪ টাকা। অডিট কমিটিও কোনো ভুল ধরতে পারেনি। তবে তদন্ত কমিটির হিসাবে টাকার পরিমাণ হওয়ার কথা ছিল ৮ লাখ ৯৪ হাজার ২২২ টাকা। অর্থাৎ ওই শিট অনুযায়ী ২৫ হাজার ৫৫২ টাকা আত্মাসাৎ করেছেন ইদ্রিস আলী। এখন তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন।
প্রভিডেন্ট ফান্ডের অন্য আরেকটি শিটে দেখা যায়, হাসপাতালের সাবেক সহকারী হিসাবরক্ষক মফিজুল ইসলাম ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত টাকার পরিমাণ উল্লেখ করেছেন ১৪ লাখ ৬৯ হাজার ২২ টাকা। অডিট রিপোর্টেও একই টাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তদন্ত কমিটি হিসাবে করে জানতে পারে, টাকার পরিমাণ হবে ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৯৯ টাকা। অর্থাৎ ওই শিট অনুযায়ী ৭৫ হাজার ৭২৩ টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন মফিজুল ইসলাম। অবসর গ্রহণ করার পর তিনি মারা গেছেন।
হিসাবের আরেকটি শিটে দেখা যায়, সহকারী পরিচালক (অর্থ) গাজী মো. সেলিম মিয়া ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত টাকার পরিমাণ উল্লেখ করেছেন ১৮ লাখ ৭৬ হাজার ৪১৬ টাকা। অথচ তদন্ত কমিটি তা পেয়েছেন ১৮ লাখ ১৭ হাজার ১৮৮ টাকা। অর্থাৎ ওই শিট অনুযায়ী ৫৯ হাজার ২২৮ টাকা আত্মাসাৎ হয়েছে। অবসরে গেছেন শিশু হাসপাতালের সাবেক এ কর্মকর্তাও।
এ পাঁচটি শিটে আত্মসাৎ হওয়া টাকার পরিমাণ পাওয়া গেছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯৮। আত্মসাৎ হওয়া টাকার সঙ্গে ১৩ শতাংশ (ঢাকা শিশু হাসপাতালের প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদের হার) সুদ যোগ করলে গত ১৫ বছরে টাকার পরিমাণ দাঁড়ানোর কথা কয়েকগুণ। সেই হিসাবে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে শিশু হাসপাতালের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামনে যারা অবসরে যাবেন, তখন টাকা দেওয়ার সময় হাসপাতালের ফান্ড থেকে অতিরিক্ত টাকা ভর্তুকি দিয়ে টাকা পরিশোধ করতে হবে, যা হাসপাতালের জন্য অনেক বড় ক্ষতি।
গত ৩০ অক্টোবর ৩৩৮ নম্বর ক্যাশ পেমেন্ট ভাউচারে দেখা যায়, সহকারী পরিচালক এ এইচ এম নেছার উদ্দিন বিল বাবদ ৬ হাজার ১৮০ টাকা নিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি আপ্যায়ন বিল দেখিয়েছেন ১ হাজার ৪৭০ টাকা এবং যাতায়াত বিল দেখিয়েছেন ৪ হাজার ৭১০ টাকা। তিনি ১৭, ২১, ২২, ২৩ ও ২৪ অক্টোবর যাতায়াত ও আপ্যায়ন বাবদ এ বিল তুলে নিয়েছেন।
একইভাবে ১০ অক্টোবর ২৫৮ নম্বর ক্যাশ পেমেন্ট ভাউচারে দেখা যায়, নেছার উদ্দিন ১০ হাজার ২৩০ টাকা তুলে নিয়েছেন। এর মধ্যে আপ্যায়ন বাবদ ৩ হাজার ৩৬০ টাকা, যাতায়াত বিল ৪ হাজার ৮৭০ টাকা ও বিবিধ খরচ বাবদ ২০০০ টাকা দেখিয়েছেন।
আবার ১৭ অক্টোবর ২৯৮ নম্বর ভাউচারে দেখা যায়, নেছার উদ্দিন ৩ হাজার ১৪০ টাকা তুলে নিয়েছেন। এর মধ্যে আপ্যায়ন বাবদ ৭৪০ টাকা, যাতায়াত বাবদ ১ হাজার ৯০০ টাকা ও বিবিধ বাবদ ৫০০ টাকা দেখিয়েছেন।
গত ২ সেপ্টেম্বর ১২৬ নম্বর ক্যাশ পেমেন্ট ভাউচারে দেখা যায়, নেছার উদ্দিন ২৪ হাজার ৩৮৫ টাকা তুলে নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৩৫ টাকা যাতায়াত বাবদ, ৫ হাজার ১৫০ টাকা আপ্যায়ন বাবদ বিবিধ খরচ বাবদ ৩ হাজার ২০০ টাকা দেখিয়েছেন।
১৭ জুলাই ২৪ নম্বর ভাউচারে দেখা যায়, নেছার উদ্দিন সম্মানি ভাতা বাবদ ১৪ হাজার টাকা ও আপ্যায়ন বিল বাবদ ১ হাজার টাকাসহ মোট ১৫ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। ১০৫৩ নম্বর ভাউচারেও ১০ হাজার টাকা সম্মানি বাবদ তুলে নিয়েছেন। এভাবে ২১ নম্বর ভাউচারে দাফতরিক খরচ বাবদ এককালীন ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, নেছার উদ্দিন নবম গ্রেডের একজন কর্মকর্তা। হাসপাতাল ও সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি একদিনে ঢাকা সিটিতে যাতায়াত বাবদ বিল করতে পারবেন ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা। অথচ তার বিল ভাউচারে দেখা গেছে, একদিনে ৩৫০ টাকা, ৪০০ টাকা, ৭০০ টাকা, এমনকি তারও বেশি বিল দেখিয়েছেন। আবার তিনি যাতায়াতে উবার ব্যবহার করেছেন, যেটিও বিধিতে নেই। খাবারের বেলায় একদিনে তিনি সর্বোচ্চ ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা বিল করতে পারবেন। সেখানেও দেখা গেছে ৫০০ টাকা, ৭০০ টাকা, ১০০০ টাকা, এমনকি তারও বেশি বিল করেছেন।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সিপিএফ ফান্ড সংক্রান্ত কমিটির একজন সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করে তদন্ত কমিটি করা উচিত ছিল। নিয়মও তাই। কারণ স্বপদে বহাল থাকলে তদন্তে বিঘ্ন ঘটতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটাই করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী পরিচালক নেছার উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, টাকা আত্মসাতের বিষয়টি তার জানা নেই। আর উপপরিচালক শাহ আলম মিয়া বলেন, একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে, সেটি তিনি জানতে পেরেছেন। তবে টাকা আত্মসাতের বিষয়ে কিছু জানেন না তিনি।
প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য ডা. গজেন্দ্র নাথ সারাবাংলাকে বলেন, তদন্তে দু’জন ব্যক্তির (শাহ আলম ও নেছার উদ্দিন) মাধ্যমে অর্থ নয়-ছয়ের বিষয়টি ধরা পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. সফি উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ হয়েছে— এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখনো প্রতিবেদন হাতে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদন হাতে পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সারাবাংলাকে বলেন, ঢাকা শিশু হাসপাতালের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা নয়-ছয়ের বিষয়টি আমরা নজর রেখেছি।