সংসদে রাঙ্গাঁকে তুলোধোনা
১২ নভেম্বর ২০১৯ ২১:৩২
সংসদ ভবন থেকে: জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও সংসদের বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাঁকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার পাশাপাশি তাকে জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিবের পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন সংসদ সদস্যরা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলনে শহিদ নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তি ও ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ায় তার কঠোর সমালোচনা করেছেন তারা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়াও রাঙ্গাঁর নিজ দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরাও তাকে রীতিমতো তুলোধুনো করেছেন জাতীয় সংসদে।
মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) সংসদ অধিবেশনের পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্যরা রাঙ্গাঁকে জাপা মহাসচিবের পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান। এসময় সংসদে তার বিরোধী দলীয় চিফ হুইপের পদ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। তীব্র ক্ষোভ, উত্তেজনা ও অসন্তোষের মধ্যে দলের পক্ষ থেকে মশিউর রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যের জন্য দুঃখ ও ক্ষমা চেয়ে জাতীয় পার্টির দু’জন সিনিয়র সদস্য দাঁড়িয়ে বলেন, এটি জাতীয় পার্টির নয়, মশিউর রহমান রাঙ্গাঁর একান্তই ব্যক্তিগত বক্তব্য। এর দায় জাতীয় পার্টি নেবে না। তবে তার এই লজ্জাজনক বক্তব্যের কারণে আমরা দুঃখপ্রকাশ করছি, ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
আরও পড়ুন- মহাসচিব পদ হারাচ্ছেন রাঙ্গাঁ!
একপর্যায়ে সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও মহাসচিব রাঙ্গাঁর কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেন। একসময় যুবদল করে আসা মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ কিভাবে জাপা মহাসচিব এবং একসময় প্রতিমন্ত্রীও হয়েছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
রাঙ্গাঁকে নিয়ে সংসদ উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও এসময় তিনি সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন। তবে সংসদ সদস্যদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানোর একপর্যায়ে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে নিজ আসন থেকে উঠে গিয়ে অধিবেশনে থাকা সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কিছু সময় কথা বলতে দেখা যায়। তবে অধিবেশনে এ বিষয়ে নিজে কোনো কোন কথা বলেননি জি এম কাদের।
মাগরিবের নামাজের বিরতির পর পয়েন্ট অব অর্ডারে অনির্ধারিত এ বিতর্কের সূত্রপাত করেন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী। এসময় রাঙ্গাঁকে নিয়ে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, গণফোরামের সুলতান মনসুর, তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও মুজিবুল হক চুন্নু। তারা সবাই জাপা মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাঁর কটূক্তিমূলক বক্তব্যের কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি তাকে সংসদে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান।
অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ জানিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ সেই চেষ্টা করেছেন। নূর হোসেন যখন হত্যা হয়, তখন দেশে ফেনসিডিল-ইয়াবা ছিল না। ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু’র কথা বলা হয়। এই ভোট ডাকাতি-মিডিয়া ক্যু’র মূল হোতা ছিলেন প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। আজ সেটাকে ঢাকার জন্য রাঙ্গাঁ এত বড় দুঃসাহস দেখাতে পারেন না।
তিনি বলেন, এরশাদকে শুধু আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার বলে না, সারাবিশ্বে এরশাদ স্বৈরাচার বলে পরিচিত। তাই জাপা মহাসচিব রাঙ্গাঁকে অবশ্যই তার কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আরেক সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও মশিউর রহমান রাঙ্গাঁকে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তার বক্তব্যে বাংলার মানুষের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। নূর হোসেনকে হত্যার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয়, দেশের মানুষ রুখে দাঁড়ায়। অথচ রাঙ্গাঁ সাহেব ভুলে গেছেন, এরশাদ সাহেব নূর হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তার মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, সংসদে ক্ষমা চেয়েছিলেন। অথচ রাঙ্গাঁ শহীদ নূর হোসেনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। এই বক্তব্যের জন্য তাকে ধিক্কার জানাই।
তিনি বলেন, মশিউর রহমান রাঙ্গাঁর এমন বক্তব্যের কারণে সারাদেশে স্বৈরাচার শব্দটি উচ্চারণ হচ্ছে, তার কুশপুত্তলিকা দাহ হচ্ছে। তাই রাঙ্গাঁ যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেজন্য অবশ্যই তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। আর তিনি যে এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই এলাকায় আওয়ামী লীগ না থাকলে নির্বাচিত হতে পারতেন কি না, তা বলতে চাই না। আর এটুকু বলতে চাই, একজন সুস্থ মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে তার পক্ষে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী ও শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে এমন বক্তব্য দেওয়া সম্ভব না। আমি তার বক্তব্যের ঘৃণা জানাই।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ যে কথা বলেছে, এটা কোনো সুস্থ মানুষ বলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলার আগে তাকে চিন্তা করা দরকার ছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাকিস্তানের স্বার্থে কাজ করেছেন। রাঙ্গাঁর এই বক্তব্য গণতন্ত্রের ওপর আঘাত। তাকে শুধু ক্ষমা চাইলেই হবে না, জাতীয় পার্টিকেও তার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে হবে। ক্ষমা তো তাকে চাইতেই হবে, তা না হলে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষত থেকে যাবে।
গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ। কথায় আছে ’রতনে রতন চেনে….’। আমি বাকি কথাটা আর বললাম না। যে নূর হোসেনকে সামনে রেখে আমরা আন্দোলন করেছি, তাকে তিনি কটাক্ষ করেছেন। এটা করে তিনি সংসদকে অপমান করেছেন। কারণ স্বৈরাচারের পতন না হলে রাঙ্গাঁ সাহেব সংসদে এসে বসতে পারতেন না। এ কথা বলে তিনি প্রমাণ করেছেন, স্বৈরাচারের দালালদের চরিত্র পরিবর্তন হয় না।
তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, মশিউর রহমান রাঙ্গাঁর বক্তব্যে শুধু নূর হোসেনের বিরুদ্ধে নয়, দেশের স্বাধীনতা, সংসদ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রের ধারাকে অপমান করেছেন। তার এই বক্তব্যের জন্য যদি জাতীয় পার্টি কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে জাতীয় পার্টি আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। রাঙ্গাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি ক্ষমা না চাইলে জাতীয় পার্টি থেকে তাকে বহিষ্কার করতে হবে।
বিতর্কের সূত্রপাত করে তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে অপমানজনক বক্তব্যের প্রতিকার চাই। মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। এর জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এমন ধরনের দম্ভোক্তি থেকে বিরত থাকবেন, সেই প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে।
জাতীয় পার্টি জাপা মহাসচিব নূর হোসেনকে কটাক্ষ মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ