জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: বেড়েই চলেছে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। দেশে বর্তমানে ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ১৪ থেকে ১৫ লাখ। এর সঙ্গে প্রতি বছর যোগ হচ্ছে ১৩ হাজার নতুন শিশু। কিন্তু এ বিপুল সংখ্যক রোগীর জন্য দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল। দেশের মোট ১০টি সরকারি হাসপাতালে শিশু ক্যান্সার বিভাগ থাকলেও সেখানে সেবা পাওয়া যায় হাতে গোনা তিন থেকে চারটি হাসপাতালে। আর এসব রোগীর চিকিৎসায় বাংলাদেশে চিকিৎসক আছেন মাত্র ২৫ জন!
সঠিক সময়ে উন্নত চিকিৎসা পেলে শতকরা ৭০ ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যেতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। অথচ দেশে আক্রান্ত এসব শিশুদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ শিশু রোগনির্ণয়ের আওতায় আসে। কিন্তু এই ২৫ শতাংশের মধ্যে ৫৫ থেকে ৬০ ভাগ শিশুই কেবল চিকিৎসা নেয়। বাকি ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ শিশু চিকিৎসা না নিয়ে বাড়ি চলে যায়। তারা হাতুড়ে চিকিৎসক, কবিরাজসহ নানা ধরনের ভুয়া চিকিৎসকদের অপচিকিৎসায় মারা যায়।
চিকিৎসকরা বলেন, ২০০৫ সালে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু হার ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে সচেতন ও চিকিৎসা নিশ্চিত না করা হলে ২০৩০ সাল নাগাদ মৃত্যুর হার গিয়ে দাঁড়াবে ১৩ শতাংশে।
পেডিয়াট্রিক অনকোলজি ন্যাশনাল ডাটাবেজ (পিওএনডি) থেকে জানা যায়, ১৩ হাজারের বেশি শিশু দেশে প্রতিবছর নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত এসব শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর হার কত সেটা স্পষ্ট নয়। অপরদিকে, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত নতুন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে তিন হাজার দুই শ’ দুই জন। কেবল গত বছরে চিকিৎসা নিয়েছে ৫৩৬ শিশু আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনকোলজি বিভাগ ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাড়ে নয় শ’র মতো রোগী চিকিৎসা নেয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চিকিৎসা চলছে ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের। তিন বছরের অনুষাকে নিয়ে মা মেরিনা ইয়াসমীন শিশু ক্যান্সারে আক্রান্তদের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত ওয়ার্ডে বসে আছেন।
মেরিনা সারাবাংলাকে বলেন, দেড় বছর বয়সে অনুষার ক্যান্সার ধরা পরে। তারপর গত কয়েক মাস ধরেই চার দেয়ালে কাটছে তার জীবন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে নাটোরের একটি হাসপাতালে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করানো হয়। পরে মেয়ের জ্বর এবং ঠাণ্ডা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে না আসাতে এখানে চলে আসেন। তারপর ধরা পরে মেয়ের ব্লাড ক্যান্সার, তখন থেকেই এ হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হচ্ছে।’
সাধারণত ক্যান্সারের মূলে চিকিৎসকরা জেনেটিক কারণকে চিহ্নিত করলেও বর্তমান সময়ে খাবারে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার, বায়ু দূষণ, লাইফ স্টাইল, ভেজাল খাবারের কারণেও শিশুরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সারাক্রান্ত শিশুদের বেশিরভাগই ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। পাশাপাশি ব্রেইন ক্যান্সার, কোলন, বোন, নাসিকাগ্রন্থি, কিডনি এবং চোখের ক্যান্সারেও আক্রান্ত হচ্ছে শিশু। একইসঙ্গে চিকিৎসকরা বলেন, এমন অনেক শিশু রোগীও আমরা পাই যে, তারা কেন ক্যান্সারে আক্রান্ত সেটা নির্ণয় করা যায় না।
শিশু ক্যান্সার বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন ‘ডিসিপ্লিন’ উল্লেখ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান একেএম আমিরুল মোরশেদ খসরু বলেন, ‘ডিসিপ্লিনটা নতুন। আর প্রচণ্ড নেতিবাচক ধারণা রয়েছে যে, এই রোগ ভালো হয় না; এই সাবজেক্টে আসার জন্য চিকিৎকরা তাই খুব একটা আগ্রহী হন না।’
একই সঙ্গে পুরো বাংলাদেশে শিশু ক্যান্সার বিষয়ে পোস্ট নেই হাসপাতালগুলোতে। সাধারণত মানুষ প্রোমোশন বা অধ্যাপক হতে পারবে সেই বিষয়ে পড়বে— এটাই স্বাভাবিক মন্তব্য করে অধ্যাপক আমিরুল মোরশেদ বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে ২০০৮ সালে সরকারি পর্যায়ে মাত্র ১৯টি পোস্ট আমি তৈরি করেছিলাম। এর সঙ্গে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে কয়েকটি পোস্ট। সে হিসেবে বাংলাদেশে ২২ থেকে ২৩টি পোস্ট ছিল, তবে গত বছর দুই অথবা তিনজন শিক্ষার্থী পাস করায় চিকিৎসকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট ২৫ জনে।’
কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থাটা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার কীনা— প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটি দেশে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু সফল হচ্ছি না— আক্ষেপ এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের।’
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু কনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মমতাজ বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের সংখ্যা আমাদের দেশে একেবারেই হাতে গোনা। যতটুকু চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে দেশে অনেক কম চিকিৎসক আমাদের।’
কেন কম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যিনি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন তাকে প্রথমে একজন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হতে হয়, তারপর তাকে শিশু ক্যান্সার রোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হয়— এটা বেশ সময়সাপেক্ষ বিষয়। তা ছাড়া এখানে আগ্রহের বিষয়ও রয়েছে। সব মিলিয়েই আমাদের দেশে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞের সংখ্যা কম। তিনি জানান, কেবল বাংলাদেশেই নয় সারাবিশ্বেই শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের সংখ্যাা কম।
সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ