Thursday 31 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বুক চাপড়ে কাঁদছে বাবা, চোখের পানি মুছছে ৩ বছরের ছেলে


১৭ নভেম্বর ২০১৯ ১৭:২৩ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৯ ১৮:৪৮
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রতিদিনের মতো সকালে চট্টগ্রাম আদালতে কর্মস্থলে গিয়েছিলেন আইনজীবী আতাউর রহমান। চেম্বারে বসেই খবর পান তার স্ত্রী ও ছেলে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে ছুটে যান তিনি। ভাবেননি, হাসপাতালে দেখবেন স্ত্রী-সন্তানের নিথর দেহ। কিন্তু সেটাই দেখতে হলো তাকে। মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে নেমে এল অন্ধকার। বুক চাপড়ে কান্না করতে করতে হাসপাতালের মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন আতাউর। সদ্য মা-ভাইহারা তিন বছর বয়সী আরেক ছেলেকে বুকে আগলে ধরে কাঁদছিলেন তিনি। আর বাবার চোখের পানি মুছে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন অবুঝ শিশুটি। এই দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি হাসপাতালে জড়ো হওয়া লোকজনও।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটা ব্রিক ফিল্ড রোডে জনতা ফার্মেসির পেছনে বাদশা মিয়া ভবন সংলগ্ন বড়ুয়া বিল্ডিংয়ে বিস্ফোরণ হয়। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কালিয়াইশ গ্রামের বাসিন্দা আতাউর রহমানদের বাসা পাথরঘাটার নজু মিয়া লেইনে। তিনি জানান, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত দেওয়াল তার স্ত্রী ও সন্তানের ওপর পড়েছে।

আতাউর রহমানের ছোট ছেলের গৃহশিক্ষিকা এলিনা বিশ্বাস জানান, তার বড় ছেলে ৮ বছর বয়সী আতিকুর রহমান শুভ পড়ত সেন্টপ্লাসিড স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ছোট ছেলে তিন বছর বয়সী আতিফুর রহমান শুভ্র পড়ে সেন্টপ্লাসিডের সামনে ব্রাদার ফ্লেভিয়ান কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। প্রতিদিন সকালে মা জুলেখা বেগম ফারজানা তাদের স্কুলে নিয়ে যেতেন। রোববার সকালে মা ফারজানা প্রথমে শুভ্রকে স্কুলে দিয়ে আসেন। এরপর শুভকে নিয়ে যাচ্ছিলেন ব্রিক ফিল্ড রোডে মারিয়া ভবনে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে।

এলিনা বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাসাও ব্রিক ফিল্ড রোডে। প্রতিদিন ফারজানা আন্টি হেঁটে ছেলেদের নিয়ে স্কুলে যেতেন। আজ সকালে আমি উনার বাসায় গিয়ে দরজায় তালা দেখি। পরে আমি সেখানে আরেকটি টিউশনিতে যাই। সেখানে শুনি আমার ছাত্র এবং তার মা বিস্ফোরণে আহত হয়েছে। আমি আবার তাদের বাসায় যাই। সেখান থেকে খবর নিয়ে হাসপাতালে আসি।’

আতাউর রহমান হাসপাতালে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘ও খোদা, তুই এ কি দেহালি ? আমি এক টাকা ফিস ছাড়া গরীব মানুষের মামলা লড়ি। খোদা তারপরও আমার ওপর কেন গজব দিল ?’

আতাউরদের মতো স্বজনহারা এবং আহতদের স্বজনদের কান্নায় রোববার (১৭ নভেম্বর) সকাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। জরুরি বিভাগের আশপাশ, বিভিন্ন ওয়ার্ড, মর্গের সামনে শুধু আর্তনাদ আর আর্তনাদ।

বিস্ফোরণে স্ত্রী এবং এক বছরের এক মেয়ে রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন নুরুল ইসলাম (৩০)। তাদের বাড়ি কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায়। স্ত্রী সাদিয়া সুলতানা (১৯) এবং শ্বাশুড়ি মনোয়ারা বেগমকে নিয়ে চান্দগাঁও থানার ক্ষেতচর এলাকায় থাকতেন পেশায় রঙমিস্ত্রি নুরুল ইসলাম।

শ্বাশুড়ি মনোয়ারা বেগম সারাবাংলাকে জানান, সকালে পাথরঘাটায় একটি বিল্ডিংয়ে রঙ করার কাজে এসেছিলেন নুরুল ইসলাম। সকাল ১০টার দিকে তারা খবর পান, সে খুব আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। হাসপাতালে এসে দেখেন, নুরুল আর বেঁচে নেই।

হাসপাতালে এক বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে এসে সদ্যমৃত স্বামীর মুখ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন দুই বছর আগে বিয়ে হওয়া সাদিয়া। বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন আর বারবার বলছিলেন, ‘অ-ঝি, বাপ কারে ডাকিবা? (মেয়ে, বাবা কাকে ডাকবে ?)’

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার শান্তিরহাট এলাকার মেহেরআঁটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা অ্যানি বড়ুয়াও ঘর থেকে বেরিয়েই লাশ হয়ে ফিরেছেন। যাচ্ছিলেন স্কুলে পিইসি পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করতে। স্বামী সরকারি শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্রের যান্ত্রিক প্রকৌশলী পলাশ বড়ুয়া। বাড়ি পটিয়া উপজেলার উনাইনপুরা গ্রামে। তাদের দুই ছেলের মধ্যে প্রথমজন পড়ে অষ্টম শ্রেশিতে, ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে। তাদের বাসা ঘটনাস্থলের পাশে ব্রিক ফিল্ড রোডে।

অ্যানি বড়ুয়ার ছোট ভাই অনীক বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরীক্ষার ডিউটি থাকায় আমার বোন একটু আগে বেরিয়েছিলেন। ব্রিক ফিল্ড রোডে যেখনে ঘটনা হয়, সেখানে একজন সহকর্মীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, একসাথে যাবার জন্য। তার স্বামী তাকে বাসা থেকে বিদায়ও দেন। আমার বোনটা লাশ হয়ে পড়ে আছে।’

পলাশ বড়ুয়া কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছিলেন না। বারবার শুধু বলছিলেন, ‘আমার দুই ছেলেকে আমি কি বলব? কিভাবে বোঝাব, তাদের মা কোথায়?’

রোববার সকালের এই বিস্ফোরণে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে চারজন পুরুষ, দুজন নারী ও একজন কিশোর। মৃতদের মধ্যে চারজনের পরিচয় শনাক্ত করা গেলেও বাকিদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারি পরিচালক ডা. হুমায়ন কবীরের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যমতে, বিস্ফোরণে সাতজন নিহতের পাশাপাশি আহত হয়েছেন ১০ জন। তাদের মধ্যে এক নম্বর ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে ৫ জন, ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে ১ জন, ২৬ নম্বর অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে ১ জন, ১২ নম্বর কার্ডিওলজি ওয়ার্ডে ২ জন এবং ৩৬ নম্বর বার্ন ওয়ার্ডে একজনের চিকিৎসা চলছিল।

আহতদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন, মো. ইউসুফ (৪০), আব্দুল হামিদ (৪০), সন্ধ্যা রাণী দেবী (৫০), অর্পিতা নাথ (১৫), মো. আরিফ (১৫), মো. নাজির (৬৫), মো. ইসমাইল (৩০), ডরিন তিশা গোমেজ (২২)। এছাড়া দুজন অজ্ঞাতনামা হিসেবে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সহকারী রেজিস্ট্রার নারায়ণ চন্দ্র ধর সারাবাংলাকে জানান, বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অর্পিতা নাথের (১৫) অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তার শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে গেছে ও শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

আহত ডরিন তিশা গোমেজ পাথরঘাটার বান্ডেল রোডে সেন্ট জনস গ্রামার স্কুলের জুনিয়র শিক্ষিকা। বাসা ব্রিক ফিল্ড রোডে। মাথায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত ডরিনকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় দেখা গেছে। ওই স্কুলের অধ্যক্ষ পূরবী সরকার সারাবাংলাকে জানান, ডরিন রিকশায় করে স্কুলে যাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণে দেওয়াল ভেঙে তার রিকশার ওপর পড়ে।

আহত ইউসুফ ও ইসমাইল মাছ বিক্রেতা। পাথরঘাটার ফিশারিঘাট থেকে মাছ কিনে তারা কদমতলী এলাকায় নিয়ে বিক্রি করে। মাছ আনতে যাওয়ার পথে দুজন আহত হয়েছেন বলে জানান ইউসুফ।

যেভাবে বিস্ফোরণ ঘটে

পাথরঘাটার ব্রিক ফিল্ড রোডে পাঁচতলা বিশিষ্ট বড়ুয়া ভবনের নিচতলায় কাজল দেবনাথের বাসায় বিস্ফোরণ হয়। ওই বাসায় থাকেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বাসিন্দা কাজল দেবনাথ, তার স্ত্রী মণি রাণী দেবী, মেয়ে অর্পিতা নাথ (১৫) ও ছেলে অর্ণব দেবনাথ (১২)। তাদের সঙ্গে থাকেন মণি রাণীর বড় বোন সন্ধ্যা রাণী দেবী।

ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সন্ধ্যা রাণী দেবী সারাবাংলাকে জানান, বাসায় তিনি এবং অর্পিতা ছিলেন। পূজা দেওয়ার জন্য বাতি দিতে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ হয়। এরপর তিনি আর কিছুই জানেন না।

চিকিৎসাধীন অর্পিতা নাথের সঙ্গে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মো. আব্দুর রউফ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাসায় দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ হয়েছে। আমাদের ধারণা, বাসায় গ্যাসের চুলার চাবি অন করা ছিল। এতে গ্যাস নিঃসরণ হয়ে পুরো বাসা চেম্বারে পরিণত হয়েছিল। অথবা বাসার গ্যাসের লাইনে লিক হয়ে বিস্ফোরণ হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস এবং বিস্ফোরক অধিদফতরকে বিষয়টি পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্ত করতে বলা হয়েছে।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিস্ফোরণে বড়ুয়া ভবনের দুটি ঘরের দেওয়ালের একাংশ বিধ্বস্ত হয়েছে। আশপাশের ভবনের বিভিন্ন বাসার দরজা-জানালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি ওষুধের দোকান ও একটি স্টুডিওর আসবাবপত্র ভেঙেচুরে গেছে ও লোহার দরজা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বড়ুয়া ভবনের পাশে আহমদ মঞ্জিলের ভাড়াটিয়া জেসমিন আক্তার মলি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টার পরে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে বাসা থেকে বেরিয়ে দেখি, সামনের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় দেওয়াল ভেঙ্গে পড়েছে। ভাঙা কাচ, ঘরের জিনিসপত্র রাস্তায় পড়ে আছে।’

জানা গেছে, যে বড়ুয়া ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে দুজন আহত হয়েছেন। বাকি যারা হতাহত হয়েছেন তারা সবাই পথচারী।

শিক্ষা উপমন্ত্রী ও চসিক মেয়রের অনুদান

এদিকে নিহতদের প্রত্যেকের দাফন ও প্রাথমিক কাজের জন্য ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে উপমন্ত্রী ১০ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের কথাও জানিয়েছেন তিনি।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান। এ সময় তিনি নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১ লাখ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। এছাড়া আহতদের চিকিৎসার খরচ বহন করা হবে বলেও মেয়র জানিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বিস্ফোরণ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর