টিসিবির পেঁয়াজ ঘিরেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য!
১৭ নভেম্বর ২০১৯ ২৩:৫২
ঢাকা: বেশকিছু দিন ধরেই পেঁয়াজের বাজার লাগামহীন। কোনো কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না নিত্য প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দামের ঊর্ধ্বগতি। তাই পণ্যটি কম দামে ক্রেতা বা ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ট্রাকসেল চালু করেছ। কিন্তু টিসিবির এই পেঁয়াজের ট্রাক ঘিরেও গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। তাদের দৌরাত্ম্যে ঠিকমতো পেঁয়াজ কিনতে পারছে না সাধারণ ক্রেতারা। সিন্ডিকেটের কাছে অনেকটাই অসহায় সাধারণ ক্রেতারা। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই।
সাধারণ ক্রেতাদের অভিযোগ, পেঁয়াজের দাম বাড়ার পর থেকে রাজধানীতে স্বল্পমূল্যে ট্রাকে করে টিসিবি পেঁয়াজ বিক্রি করছে। কিন্তু এই ট্রাকগুলো যেসব জায়গায় পেঁয়াজ বিক্রি করছে সেখানকার কিছু অসাধু লোকজন সংঘবদ্ধ (সিন্ডিকেট) হয়ে সাধারণ মানুষকে পেঁয়াজ কিনতে বিড়ম্বনায় ফেলছে। চক্রের সদস্যরা সাধারণ ক্রেতাদের লাইন ঠেলে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেদেরকে টিসিবির লোক বলে দাবি করে। ফলে সাধারণ ক্রেতারা প্রতিবাদ করে না। এ সুযোগে সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা প্রতিদিন সেখান থেকে পেঁয়াজ কিনে তা অন্য জায়গায় বেশি দামে বিক্রি করছে।
এইসব কাজে টিসিবির লোকজনই সহায়তা করছে বলে অভিযোগ সাধারণ ক্রেতাদের। তাই এ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে সঠিক মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়েছেন ক্রেতারা। তবে টিসিবি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনবল সংকটের কারণে অনেক সময় এসব চোখের সামনে ঘটলেও নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আর এসব নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা প্রয়োজন বলে দায়ও এড়াচ্ছে তারা। ফলে এসব সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে মিলছে না কার্যকর কোনো সমাধান।
রোববার (১৭ নভেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, টিসিবি ভবনের পাশে স্বল্পমূল্যে (প্রতি কেজি ৪৫ টাকা) পেঁয়াজ কেনার জন্য প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন। যাদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের কেউ কেউ সকাল নয়টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন মাত্র এক কেজি পেঁয়াজ কেনার জন্য। তাদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চার ঘণ্টা পর দুপুর একটায় সেখানে আসে টিসিবির পেঁয়াজ ভর্তি একটি ট্রাক। ট্রাকটিতে এক হাজার কেজি পেঁয়াজ রয়েছে বলে জানান টিসিবি সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু বিক্রি শুরুর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘোষণা আসে, সব পেঁয়াজ শেষ। অর্থাৎ এক ঘণ্টায় এক হাজার কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু তিন শতাধিক মানুষের লাইনের অর্ধশতাধিক ক্রেতা তখন পর্যন্ত পণ্যটি কিনতে পারেননি।
প্রায় দুই ঘণ্টা সরজমিনে থেকে দেখা যায়, পেঁয়াজ ভর্তি ট্রাকে আসার অনেক আগে থেকেই বেশ কয়েকজন (৮-১০ জন) ব্যক্তি নিজেদেরকে টিসিবির লোক দাবি করে সাধারণ ক্রেতাদেরকে লাইন সাজিয়ে দিচ্ছে। কেউ যাতে লাইন না ভাঙে সেজন্য তারা পাহারাও দিচ্ছে। কিন্তু যখন ট্রাক এলো ঠিক তখনই ঘটল বিপত্তি। এতক্ষণ ধরে যারা সাধারণ ক্রেতাদের লাইন ঠিক করেছিল তারাই লাইনে ঢুকে গেল; তাও আবার সামনের সারিতে। এ সময় তারা নিজেদেরকে টিসিবির লোক বলে দাবি করে। তাদের কেউ কেউ দাবি করেছে টিসিবির গাড়ির ড্রাইভার। আবার কারও দাবি, সে টিসিবিতে কর্মচারী হিসেবে কাজ করছে।
কিন্তু তাদের পরিচয় জানতে চাইলে এ প্রতিবেদককে তারা জানায়, তারাও সাধারণ ক্রেতা। টিসিবিতে তারা কাজ করে না। তাহলে কেন সাধারণ ক্রেতাদেরকে টিসিবির লোক দাবি করেছিলেন? এমন প্রশ্নে তারা জানায়, ‘এ কথা তারা বলেনি ‘ নিজ কানে শুনেছি বলার পর তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এ প্রতিবেদকের ওপর। এ সময় সেখানে টিসিবির পণ্যের নিরাপত্তা পরিদর্শক এম এ বারী উপস্থিত থাকলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি।
বাহিরের লোকজন নিজেদেরকে টিসিবির লোক বলে সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গে প্রভাব খাটাচ্ছে- এ বিষয়ে আপনাদের পদক্ষেপ কী? এমন প্রশ্নে এম এ বারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা আমার দেখার বিষয় না। আমার দায়িত্ব হল ট্রাকে ঠিকমতো পেঁয়াজ এলো কিনা সেটি দেখা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারওয়ান বাজারের এক পান বিক্রেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওরা প্রতিদিনই এখান থেকে পেঁয়াজ কেনে। এসব পেঁয়াজ আবার বাজার দামে অন্যদের কাছে বিক্রি করে। এটাই ওদের কাজ। ওদের ৮/১০ জনের একটা গ্রুপ আছে। তারা টিসিবির লোকদের সহযোগিতায় এমন কাজ করে।’
সিন্ডিকেটের সদস্যদের দৌরাত্ম্যে পেঁয়াজ নিতে না পেরে আব্দুস সালাম নামে এক রিকশাচালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সকাল ১১ টার দিকে এসে লাইনে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরে একজন এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। প্রতিবাদ করতেই তারা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে লাইন থেকে বের করে দিল। তারা নিজেদের টিসিবির লোক বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।’ আশপাশের সাধারণ ক্রেতারাও রিকশাচালকের কথা সত্যতা স্বীকার করেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘এসব নিয়ন্ত্রণে করতে হলে জনবলের দরকার। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত জনবল সংকট রয়েছে। আবার যারা এসব সিন্ডিকেটের কাজ করে তাদের ধরাও কঠিন। তারা সব সময় আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে। এক সময় তারা লাইনে দাঁড়িয়ে যাাচ্ছে। এমনকি তাদের ছেলেমেয়েদেরও দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তাদের কীভাবে ধরব?’
‘তাহলে এসব নিয়ন্ত্রণ করবে কারা?’- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এসব নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। যদিও মন্ত্রণালয় থেকে সে ধরনের নির্দেশনা রয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, পণ্য বিক্রির সময় তারা আশপাশে থেকে শৃঙ্খলা বজায় রাখা জন্য কাজ করবে। অনেক সময় তারা থাকে, আবার অনেক সময় থাকে না। এ কারণে হয়তো সমস্যা দেখা দেয়।