রানারাই বাঁচিয়ে রাখে আওয়ামী লীগকে
২০ নভেম্বর ২০১৯ ০৯:৪৩
এই ছবিটা ভালোভাবে খেয়াল করে দেখুন। বিশেষ করে যারা আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। যারা আওয়ামী লীগ ও এর কোনো অঙ্গ সংগঠনের পদধারী নেতা। যারা নেতা হতে চান, যারা কর্মী বা যারা সমর্থক; তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখুন। ছেড়া-ময়লা শার্ট, মলিন চেহারা, চোখে কোনো আগুন নেই, আশা নেই, একদম মাছের চোখের মত ভাবলেশহীন। দেখলেই বোঝা যায়, পুরোপুরি সুস্থও নন তিনি। বয়স এখনও ৫০ পেরোয়নি, কিন্তু এরই মধ্যে হেরে বসে আছেন জীবনযুদ্ধে। জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া এমন অনেক মানুষ আছে দেশে। তবে এই ছবি নিয়ে এত কথা কেন? কারণ সময়ের আগেই হেরে যাওয়া এই মানুষটি একসময় রাজপথের সৈনিক ছিলেন। দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে লাল রুমাল বেঁধে দেওয়ার সাহস নিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন। এই সৈনিকটির নাম মোতাহার হোসেন রানা। তিনি চট্টগ্রামের মিরেরসরাই উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়তে গিয়ে কবি জসীমউদদীন হল ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রলীগের হয়ে হল সংসদের নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন। ছিলেন ছাত্রলীগের মাইনউদ্দিন হাসান চৌধুরী-ইকবালুর রহিম কমিটির সদস্য ছিলেন। সেই কমিটির অনেকেই মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগা মোতাহার হোসেন রানা আজ অসুস্থ, উপেক্ষিত, অবহেলিত। গত ১৬ নভেম্বর মিরেরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দর্শক সারিতে অসহায় অবস্থায় বসেছিলেন মোতাহার হোসেন রানা। সেই মুহূর্তের একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। প্রথম আমার চোখে পড়ে চট্টগ্রামের সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা হাসান মনসুরের স্ট্যাটাস। তারপর আরও অনেকেই সেটি শেয়ার করেছেন বা আলাদা করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। হাসান মনসুর তার স্ট্যাটাসে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, মোতাহার হোসেন রানা তুখোড় বক্তা ছিলেন। এমনকি তার বক্তৃতা শুনে প্রশংসা করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। আমি পরে হাসান মনসুরের সাথে কথা বলেছি; কথা বলেছি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাইনউদ্দিন হাসান চোধুরীর সঙ্গেও। তিনি তার কমিটির এই সদস্যের মধুর স্মৃতির কথা স্মরণ করলেন, একই সঙ্গে জানালেন তার দুর্ভাগ্যের কথাও। ১৯৯৩ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন মোতাহার। দুর্ঘটনার সময়ও তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। মিরেরসরাইয়ে দুর্ঘটনার পর তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তখনকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি করা হয়। তার চিকিৎসক ছিলেন দেশসেরা নিউরো সার্জন রশিদউদ্দিন আহমেদ। তার সহকারী ছিলেন বিএসএমএমইউর বর্তমান ভিসি কনক কান্তি বড়ুয়া। রানার আঘাত খুবই গুরুতর ছিল। সবাই তাঁর বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। একাধিকবার তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯ দিন অচেতন থাকার পর জ্ঞান ফেরে তাঁর। কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেলেও মস্তিস্কে গুরুতর আঘাতের কারণে আর কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তারপর থেকেই চলছে তার জীবনযুদ্ধ। কিছুদিন ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে কাজও করেছেন। ৩ ছেলে, ৩ মেয়ে নিয়ে তার বেশ বড় সড় সংসার। এখনও সেই সংসার চলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেওয়া ভাতায়।
জীবনে অনেককিছু হারিয়েছেন, অনেককিছু ছেড়েছেন; কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়তে পারেননি। আওয়ামী লীগের গত অধিবেশনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার বিদায়ী বক্তৃতায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ নিছক একটি সংঠন নয়, এটি একটি অনুভূতির নাম। আর মোতাহার হোসেন রানারা হলেন সেই অনুভূতির প্রকাশ। এই যে নিজের এত হতদরিদ্র দশা, তারপরও কারও বিরুদ্ধে তাঁর কোনো অভিযোগ নেই। আওয়ামী লীগের সাফল্যেই তাঁর আনন্দ। তাই তো নিজের হাতে গড়া কর্মীরা যখন এখন বড় নেতা, বড় পদ; তারাই যখন মঞ্চ মাতায়; তখন মোতাহার হোসেন রানা দর্শক সারিতে বসে থাকেন অসহায়ের মতো, কেবল আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে। রানা হয়তো দুর্ভাগ্যের শিকার। কিন্তু এমন অনেক দুর্ভাগা আওয়ামী কর্মী আছে দেশে। স্মার্ট, ড্যাশিং, হাইব্রিড আওয়ামী লীগারদের ভিড়ে আনস্মার্ট রানাদের এখন কোনো ঠাঁই নেই। তবুও দলকে ভালোবেসে তাঁরা লেগে থাকেন কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার, নিশ্চিহ্ন করার অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি এই রানাদের মত নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের জন্যই। ৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত যারা আওয়ামী লীগ করেছেন, তারা তো জানতেন না এই দল কখনও ক্ষমতায় যাবে; শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোতাহার হোসেন রানার আজ এই অবস্থা। কিন্তু এখন ছাত্রলীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতার দাপটেও টেকা যায় না। অর্থ কামানোর কত যে ধান্দা। কিন্তু ৭৫ থেকে ৯৬ সময়ের নেতারা কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়, দিনের পর দিন সামরিক শাসকের রক্ষচক্ষু উপেক্ষা করে মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে, আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে। এই আওয়ামী কর্মীদের সাথে ২০০৮ সালের পর আাসা আওয়ামী লীগারদদের আকাশ-পাতাল ফারাক। বিএনপি, জামায়াত তো বটেই, এমনকি ফ্রিডিম পার্টির নেতারাও এখন আওয়ামী লীগ বনে গেছেন। এখন দেশে অনেক আওয়ামী লীগার। চারদিকে যেদিকে তাকাবেন, সেদিকেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে এদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখন আওয়ামী লীগের পাশে থাকবে, দলকে বাঁচাবে এখনকার অবহেলিত এই রানারাই।
লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।