Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমাদের টিভি নাটক ও নতুন নতুন টিভি চ্যানেল


২১ নভেম্বর ২০১৯ ১৫:৫৪

বাংলাদেশে মঞ্চ নাটকের ইতিহাস খুব বেশি দিনের না। স্বাধীনতার পর মঞ্চ নাটক নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের থিয়েটার সংগঠনগুলো। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক এখন মর্যাদার আসন অর্জন করেছে। এই মঞ্চ নাটকের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের হাত ধরেই আমাদের টিভি নাটক দর্শকদের কাছে ভীষন জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দেশের সেরা নাট্যকার, সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলী সবার অংশগ্রহনে মুখরিত ছিলো রামপুরা টেলিভিশন কেন্দ্র। বিটিভির মেধাবী প্রযোজক-পরিচালকেরা কোনো না কোনো গ্রুপ থিয়েটারের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। কিন্তু এর ফলে বিটিভির নাটকে মঞ্চ নাটকের প্রভাব ছিলো একথা বলা যাবেনা, কারন প্রযোজকেরা ততদিনে টিভি নাটকের একটা নতুন ধারা তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

টিভি নাটকের এই নতুন ধারা কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারত সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে সেখানকার টিভি নাটকে মঞ্চ বা রেডিও নাটকের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আমরা যদি ভারতের কোনো বাংলা ধারাবাহিক নাটক চোখ বন্ধ করে শুনি, মনে হবে তা অতি অভিনয় দোষে দুষ্ট অথবা বেতার নাটকের প্রভাবে ভারাক্রান্ত। টেলিফিল্মের ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেখানে চলচ্চিত্রের একটি শুদ্ধ ধারার প্রভাব রয়েছে।

টিভি নাটকের শুরুর দিকটায় আমাদের এখানে নাট্যকারের অভাব ছিলো। মুনির চৌধুরী, আসকার ইবনে শাইখ, নুরুল মোমেন এরকম কয়েকজন নাটক লিখতেন। মঞ্চ নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে বিদেশী নাটকের উপর নির্ভরশীলতা ছিলো উল্লেখ করার মতো। বিটিভির (তখন পিটিভি, পরবর্তিতে বিটিভি) সেই সময়ে তরুন প্রযোজকদের অনেকেই নাট্যচর্চার সাথে যুক্ত ছিলেন। যেমন মুস্তাফা মনোয়ার, কলিম শরাফী, মোহাম্মদ জাকারিয়া, আবদুল্লাহ্ আল মামুন, আতিকুল হক চৌধুরী, মুস্তাফিজুর রহমান, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, সৈয়দ ছিদ্দীক হোসেন, নওয়াজিশ আলী খান, বরকতউল্লাহ্, জিয়া আনসারী, মুসা আহমেদ, হায়দার রিজভী প্রমুখ। আমি তাঁদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আব্দুল্লাহ্ আল মামুন আর আতিকুল হক চৌধুরী শুধু পরিচালক-প্রযোজক হিসেবে নয় নাট্যকার হিসেবেও তাঁদের রচনার সংখ্যা অসংখ্য। বিটিভির কর্মকর্তারা নাটক রচনা বা নির্মাণের জন্য কোনো পারিশ্রমিক পেতেন না, শুধুমাত্র নাটকের প্রতি ভালোবাসার জন্য তারা সব সময় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। সারা রাত জেগেও কাজ করে গেছেন। মানুষ হিসেবেও তাঁরা ছিলেন অসাধারন।

সে সময়ে টিভি নাটক রচনায় আরো এগিয়ে আসেন মামুনুর রশীদ, ডক্টর ইনামুল হক, নাজমুল আলম, মোর্শেদ চৌধুরী, ওবায়দুল হক, কাজী মাহমুদুর রহমান, মমতাজউদ্দিন আহমেদ এরকম হাতে গোনা কয়েকজন। নির্মলেন্দু গুণ ও শামসুর রাহমানের মতো কবিও এ সময়ে দু একটি নাটক টিভির জন্য লিখেছেন। কিন্তু মৌলিক রচনার অভাবে নাটক নির্মাণে কোনো প্রভাব পরেনি। কারন সেসময় বিটিভিতে রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়র, দস্তয়ভস্কি, চেখভ, স্টিন্ড্রবার্গ, টলস্টয়, মঁলিয়ের, ব্রেসট ছাড়াও প্রাচীন গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিস এবং আরো অনেক বিদেশী নাট্যকারের রচনা বাংলায় রূপান্তর করা হয়, যে নাটকগুলি আমাদের নাট্যাঙ্গনকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতার পর মঞ্চ নাটকের পাশাপাশি বিটিভির নাটকও সমৃদ্ধ হতে থাকে। নতুন নতুন নাট্যকারদের আগমন ঘটতে থাকে। এরপর এক ঝাঁক তরুনের আগমন ঘটে বিটিভিতে প্রযোজক হিসেবে, ১৯৮০-৮১ সালে। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটারের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাদের হাত ধরে টিভি নাটক আরো সমৃদ্ধ হতে থাকে। নাট্য প্রযোজক-পরিচালক হিসেবে এসময় সুনাম অর্জন করেন নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, ম হামিদ, আল্ মনসুর, খ ম হারূন, হাবীব আহসান, মাহবুবুল আলম, আবু তাহের, সালেক খান সহ বেশ ক’জন। বিটিভির নাটক এ সময়ে দেশের বাইরে পশ্চিম বাংলা, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এসব অঞ্চলেও ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

এ সময়ে নাটকের যেসব অনুষ্ঠান ছিলো তা হলো – এ সপ্তাহের নাটক, এ মাসের নাটক, গল্প থেকে নাটক, ধারাবাহিক নাটক, লোকনাটক হীরামন, বৃত্তের বাইরে, বিশ্ব নাটক, শিশু-কিশোরদের নাট্য ধারাবাহিক, কমেডি সিরিয়াল, নতুন শিল্পীদের আসর, টেলিফিল্ম, মঞ্চ নাটক ইত্যাদি।

২০০০ সালের পর থেকে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের আগমন ঘটতে থাকে একের পর এক। আশা করেছিলাম বেসরকারি টিভির প্রসারের ফলে বাংলাদেশে টিভি নাটক আরো জনপ্রিয় হবে। কিন্তু এখন কি দেখছি? এখন আর টিভি নাটকের জনপ্রিয়তা নেই, নাটক নিয়ে চর্চা নেই, গবেষণা নেই। যারা এখন নাটক তৈরী করছেন তাদের সাথে কথা বলে দেখেছি, তাদের মূল ভাবনা বাণিজ্য, সৃজনশীলতা নয়। তারা অনেকেই বিশ্বের শ্রেষ্ট নাট্যকারদের নাম জানেন না, মঞ্চ নাটক দেখেন না। তাদের চিন্তা কম খরচে নাটক নির্মাণ করে, কিছু লোকের পারিশ্রমিক না দিয়ে, টিভি চ্যানেলের সাথে একটা বোঝাপড়া করে তা সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা।

কেনো এমন হলো? কারণ গুলি খুব জটিল নয়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ টিভি চ্যানেল মালিকদের টিভি মাধ্যম সম্পর্কে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলোনা। বিশেষ করে ২০০৯ এর পর যারা টিভি চ্যানেলের অনুমোদন পেয়েছেন। মিশ্র চ্যানেলের মালিকদের টিভি মাধ্যম সম্পর্কে অজ্ঞানতার সুযোগ নেয় কিছু সুযোগ সন্ধানী গনমাধ্যম ব্যবসায়ী। চাটুকারিতা দিয়ে তারা চ্যানেল মালিকদের বশীভূত করে ফেলে। মালিকদের দুর্বল দিকগুলো ব্যবহার করে কিছু চ্যানেলে তারা জায়গা করে নেয়। নিম্নমানের নাটকের বাজার সৃষ্টিতে তৎপর হয়। তাদের কাজের সুবিধার্থে চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান বিভাগ থেকে সৃজনশীল মানুষদের বিদায় করে দিয়ে সেখানে তাদের আস্থাভাজন তল্পিবাহকদের বসানোর চেষ্টা করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুন্দরী মহিলাদের তারা ব্যবহার করে, যারা কখনো কোনো প্রযোজনার সাথে জড়িত ছিলো না। এই দূর্বলতার সুযোগে সামিল হয় প্রতিবেশী দেশের কিছু মিডিয়া ব্যবসায়ী। এদেশে জমজমাট ব্যবসা করার স্বার্থে তারা নিজ দেশে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল যাতে দেখা না যায় তা নিশ্চিত করে। কারন ঐ ব্যবসায়ীরা খুব ভালো করেই জানে বাংলাদেশে সৃজনশীল মানুষের কোনো অভাব নেই। এখানকার টিভি চ্যানেল একবার সৃজনশীল পেশাদারদের হাতে চলে গেলে ওপারের বাংলা চ্যানেলগুলো যেমন মার খাবে, তেমনিভাবে এখানে তাদের মিডিয়া ব্যবসা বিঘ্নিত হবে।

বছর দুই আগের কথা (নভেম্বর ২০১৬) নিশ্চয়ই মনে আছে। দেশের টিভি চ্যানেলের জন্য বরাদ্দকৃত এদেশের বিজ্ঞাপনগুলো তখন চলে যাচ্ছিলো ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে আমাদের দেশেরই কিছু মানুষের সহযোগিতায়। টিভি মাধ্যমে জড়িত মালিক, কর্মচারী, শিল্পী, পরিচালক, কলাকুশলীরা তখন একসাথে মাঠে নেমে আসে। ফলে তথাকথিত ব্যবসায়ীদের নীলনকশা তখন বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়িত হলে এতোদিনে অর্ধেকেরও বেশী চ্যানেল বন্ধ হয়ে যেতো। তবে ষড়যন্ত্র থেমে নেই, চলছে।

প্রথম দিকে যে সব বেসরকারী টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সেগুলোর দিকে যদি দৃষ্টি ফেরাই তাহলে ভিন্ন চিত্র দেখবো। একুশে টিভি, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, এনটিভি, আরটিভি, বৈশাখী, বাংলাভিশন, চ্যানেল ওয়ান – এই চ্যানেলগুলোর শুরুটা হয়েছিলো অত্যন্ত আশার মধ্য দিয়ে। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পেশাদার মনোভাবের ব্যক্তিবর্গের সাথে একঝাঁক তরুণ ঝাঁপিয়ে পরেছিলো চ্যালেন্জ নিয়ে। কার চ্যানেল কতোটা আকর্ষণীয় করা যায়, সেই চ্যালেন্জ। কতো নতুন নতুন শিল্পী তৈরী করা যায়, সেই চ্যালেন্জ। অনুষ্ঠানে কতো নতুনত্ব আনা যায়, সেই চ্যালেন্জ। তারপর?

তারপরের কথা আগেই বলেছি। এখন আর সেইসব চ্যালেন্জ নেই। সৃজনশীল ব্যক্তিদের জায়গাটা দখল করে ফেলেছে সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা। ছোট পর্দা এখন বেশ বড়, আর এই পর্দা এখন সত্যিই এক একটি ইডিয়ট বক্স।

আমাদের এখন অনেক অনেক গুণী নাট্যকার আছে, আছে সৃজনশীল নির্মাতা ও কলাকুশলী। তাদের অনেকেই এখন টিভি মাধ্যমে কাজ করছেন না। তবে আশা করি এই খারাপ সময়টা একদিন দূর হবে। আমাদের নিউজ চ্যানেলগুলো অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। আরো অনেক বিশেষায়িত চ্যানেল আসলে অবস্থার উন্নতি ঘটবে। তারপর হয়তো সুবিধাবাদীদের হাত থেকে মুক্তি পাবে আমাদের মিশ্র চ্যানেলগুলো। আমাদের টিভি নাটক আবার সত্যিকারের নাটক হয়ে উঠবে, সোপ অপেরা নয়।

খ ম হারূন: টেলিভিশন ও নাট্য ব্যক্তিত্ব।

আতিকুল হক চৌধুরী আবদুল্লাহ্ আল মামুন আবু তাহের আল্ মনসুর কলিম শরাফী খ ম হারূন জিয়া আনসারী টেলিভিশন নওয়াজিশ আলী খান নাটক নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বরকতউল্লাহ্ ম. হামিদ মাহবুবুল আলম মুসা আহমেদ মুস্তাফা মনোয়ার মুস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা কামাল সৈয়দ মোহাম্মদ জাকারিয়া সালেক খান সৈয়দ ছিদ্দীক হোসেন হাবীব আহসান হায়দার রিজভী

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর