পরিবেশ অস্থিতিশীল করার উসকানি, বিদেশি ইন্ধনের ইঙ্গিত বিশেষজ্ঞদের
২১ নভেম্বর ২০১৯ ২২:৫০
ঢাকা: বাবরি মসজিদ ইস্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জাল চিঠি যখন বাংলাদেশের গণমাধ্যমে জায়গা করে নেয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল হয়; ঠিক তখনই রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বেনামে উসকানিমূলক রঙিন পোস্টার দেখা গেছে। একই সময়ে পেয়াজের ঝাঁজ বাড়ার সঙ্গে লবণের দাম বাড়ার গুজব আর পরিবহন ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। সার্বিক পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্মকে ব্যবহার করে একাধিক গোষ্ঠী বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে, এতে বিদেশিদের ইন্ধন থাকাও অস্বাভাবিক নয়।
রাজধানী ঢাকার একাধিক স্থান সরেজমিনে দেখা গেছে সচিবালয়ের দেয়াল, জাতীয় প্রেস ক্লাবের দেয়াল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়াল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালসহ শহরের গুরুত্বপূর্র্ণ জায়গাগুলোতে বেনামে বড় আকারের চারকোনা রঙিন পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। এ পোস্টারে মোট ছয়টি ঘটনার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, যার একটি ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটেনি।
ছবিগুলোতে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা, আসামের এনআরসি, প্যালেস্টাইন, কাশ্মির প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট ছয়টি ছবি কোলাজ করা হয়েছে। পোস্টারের একেবারে ডানপাশে নিচ থেকে ওপরে আড়াআড়িভাবে রেখা হয়েছে ‘সেভ হিউমেনিটি’ আর পোস্টারের একবারে নিচে ডানদিকের কোনায় লেখা ‘স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রয়োজন’। কারা বা কাদের উদ্যোগে এ পোস্টারে তা কোথাও উল্লেখ নেই।
এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আব্দুর রশিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি রাজনৈতিক কৌশলের অপভ্রংশের দিকে এগুচ্ছে। দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবগুলো দেশে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে তা নয়, আফগাস্তিান-পাকিস্তানে উত্তেজনা চলছে, ভারতে কাশ্মির নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমি যেটা দেখছি যে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইস্যুভিত্তিক রাজনীতি বিরোধী দলগুলো তৈরি করতে পারেনি। যার ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সবসময়ই তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মকে সামনে রেখে একটি রাজনীতি সামনে খাড়া করেছিল। সেটি করার ফলে তারা তেমন কোনো গতি পায়নি। গতি না পাওয়ার ফলে এখন যেটি হচ্ছে তারা মনে করছে, তাদের সেই কৌশল ভুল ছিল। তাই তারা এখন জনগণকে স্পর্শ করে এমন সব ইস্যু নিয়ে মাঠে নামার চেষ্টা করছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এগুলোর ওপর তাদের কোনো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয় হোক আর বাজার হোক যেখানেই ইস্যু পাচ্ছে মনে করছে স্ফূলিঙ্গ, যাতে বিশাল আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হবে। সেটিকে তারা লুফে নিয়ে এ জন্য অপকৌশল করছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মুসলমান বেশি হওয়ায় তারা ভারতের কাশ্মির ইস্যুকে এখানে ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্য বেনামে উসকানি দেখা যাচ্ছে। স্বনামে করতে পারছে না। কারণ এ ধরনের রাজনীতি যারা করেন তাদের অনেকেই ভারতে গিয়ে মুচলেকা দিয়ে এসেছেন যে তারা বিরোধী রাজনীতি করবেন না। সেই মুচলেকার কারণে তারা সংগঠনের নাম উল্লেখ না করে বেনামে উসকানি দিচ্ছে।’
‘এখানে বিদেশি ইন্ধন থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না’ উল্লেখ করে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আব্দুর রশিদ বলেন, ‘বড় ক্যানভাসে দেখলে দেখা যায় যে, শুরু থেকেই আমাদের লড়াই বাংলাদেশি আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পক্ষে পাকিস্তান দাঁড়িয়েছে, সেটা তো আমরা দেখেছি। তারা এখনও স্বপ্ন দেখে যে বাংলাদেশকে নিয়ে পাকিস্তানের একটি পুনর্মিলন সম্ভব, জার্মানির মতো। সে জন্য এসব ক্ষেত্রে ওইসব রাজনীতিকরা তাদের পুরনো বন্ধুদের সমর্থন করে।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে। সেটা আফগানিস্তান থেকে শুরু করে মিয়ানমার পর্যন্ত। ফলে পাবলিক মিস-ইনফরমেশন হোক আর ইনফরমেশন হোক, যেটাই হোক কোনোটাই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তাই এ বিষয়গুলোকে খুব গুরুত্ব না দিলেও আন্ডারমাইন করার কোনো সুযোগ নাই। কেননা আমরা জানি না যে এই উসকানি কারা দিচ্ছে অথচ বিষয়টি আবার দৃশ্যমানও। এই উসকানিতে যে ফ্যাক্টগুলো তুলে ধরা হয়েছে তা কিন্তু আবার বাস্তবে রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের একদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে অন্যদিকে বাংলাদেশের চারদিকে বিভিন্ন রকমের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী রয়েছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান এ দেশগুলোতে বিভিন্ন রকমের অস্থিতিশীলতা আছে। ভারতেও বিভিন্ন অস্থিতিশীলতা রয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ পুরো একটা অস্থিতিশীল অবস্থানের মাঝখানে। সুতরাং বাংলাদেশে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেখানে সবসময়েই সতর্ক থাকতে হবে।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান সারাবাংলা’কে বলেন, ‘এগুলো হচ্ছে, এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করার অপপ্রয়াস। সমালোচনা করার একটি আইন সম্মত পন্থা আছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ রেখে, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখে, আমাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার অধিকার সংবিধান আমাদের দিয়েছে। যা আমরা কার্যকর করতে পারি। কিন্তু যখন এগুলোকে বাদ দিয়ে বেনামে, উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে, ভিন্ন রাষ্ট্রের ছবি ব্যবহার করে আমাদের ধর্মীয় চেতনাকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, এগুলো কিন্তু কখনোই একটি সভ্য এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘কাশ্মির নিয়ে সকলেরই একটি ব্যক্তিগত মতামত থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যদি আর্ন্তজাতিক আইনে বিশ্বাস করি তাহলে মনে রাখতে হবে যে আর্ন্তজাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শন করাটাও আমাদের সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি যদি শ্রদ্ধাবোধ থাকে তবে কিন্তু অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলা শোভনীয় নয়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা বা শত্রু সৃষ্টি করা কী অভ্যন্তরীণ বিষয় নাকি এখানে ধর্মীয় আঙ্গিক রয়েছে, এটি কিন্তু একটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ব্যাপার। যদিও ধর্মীয় আঙ্গিক থেকেও থাকে, মনে করুন, বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে বা কাশ্মিরের বিষয় নিয়ে আমরা যতটা সম্পৃক্ত হই অথচ সৌদি আরব বা জর্ডানে যেভাবে আমাদের নারী শ্রমিকরা লাঞ্ছিত হন, তারা যখন কোনোরকম অধিকার পান না, তাদেরতে যখন যৌন নিপীড়ন করা হয় সেখানে আমাদের কয়জনকে দেখেছেন যে, প্রতিবাদ করার জন্য বেরিয়েছেন? সেখানে তখন ধর্ম যায় কোথায়? তার মানে হচ্ছে, ধর্মকে আমরা রাজনৈতিক একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছি, যা কখনও কাম্য হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘এই উসকানিগুলো এমন সময়ে দিচ্ছে যখন বাজারেও অস্থিরতা চলছে। পেঁয়াজ নিয়ে অস্থিরতা, লবণ নিয়ে অস্থিরতা, চাল নিয়ে অস্থিরতা চলছে। এর ভেতরে কোনো যোগসাজস আছে কিনা তা কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিতে বিচার করলেও খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তবে আমি বলব, এ রকম যোগসাজস বা প্রবণতা তখনই বাড়ে যখন দায়িত্বশীল পদের ব্যক্তিরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কথা বলেন না। আর তখনই সুযোগ-সন্ধানীরা উসকানি দিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে।’
‘এসব উসকানির সঙ্গে যে বিদেশি কোনো শক্তির আঁতাত নেই, এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’ উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘কারণ হচ্ছে, এক. বাংলাদেশে এখন অস্বাভাবিক গতিতে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চলছে তা অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। দুই, রোহিঙ্গারা যে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে, এতে করে মিয়ানমার কোণঠাসা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাদের বিচারের একটা পথ খুলেছে, ল্যাটিন আমেরিকাতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এই যে ডেভেলপমেন্টগুলো হচ্ছে, এতে করে অনেকের মধ্যেই কিন্তু আমাদেরকে দেখে নেওয়ার একটা প্রবণতা থাকতে পারে। তাছাড়া আমরা যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছি বা করছি তা কিন্তু পাকিস্তান এবং তাদের কিছু বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে এখনও গ্রহণযোগ্য নয়। তারা এগুলো কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। তারা শুধু অপেক্ষায় আছে, কীভাবে বাংলাদেশকে একহাত দেখে নেওয়া যায়।’