কেবল শরীর পোড়েনি, পুড়েছে স্বপ্নও
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৯:৪৫
জাকিয়া আহমেদ ও সোহেল রানা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের দোতলায় আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)। আইসিইউতে ঢোকার মুখে চোখে পড়লো হাতের বাম পাশের চেয়ারে সারি বেঁধে বসে রয়েছেন তিন নারী আর এক শিশু। পরে সেখানে যোগ হয় একে একে আরও অনেকে।
জানা গেল বার্ন ইউনিটের দোতলা, তিনতলা আর চারতলা মিলিয়ে এই পরিবারের প্রায় ১৫ জন মানুষ ছিলেন সেই সময়। পরিবারের আরও সদস্যরা কেউ ঢাকার বাসা থেকে, আবার কেউবা গ্রামের বাড়ি থেকে রওনা হয়েছেন হাসপাতালের উদ্দেশে।
কথা বলে জানা যায়, এই পরিবারেই পাঁচ জন মানুষ গত রাত সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর মুগদার মানিকনগরে একটি বাসার দ্বিতীয় তলায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে লাগা আগুনে দগ্ধ হন। পরে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার জন্য দৌড়ে এসে চেয়ারে বসেন শিপা, গায়ে আইসিইউর পোষাক। কথা হয় শিপার সঙ্গআইসিইউতে কে জানতে চাইলে নিজের ফোন থেকে ছবি বের করে বলেন, দেখেন-এটা আমার ছোট ভাই। ১২ বছরের মুরাদ। সপ্তম শ্রেণিতে পরে, দেখেন মুখটা পুইড়া কেমন হইছে। বলে নিজেই ছবিটা আরও কাছে এনে বলতে থাকেন, পুরো মুখে কেবল ফোসকা ছাড়া আর কিছু নেই। শিপা ফোনে থাকা ছবি দেখাতে থাকেন তার আশপাশের সবাইকে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলতে থাকেন, আমার ছোট ভাই-মুখে ফোসকা ছাড়া আর কিছু নেই, ভাইটা পুইড়া কেমন কালো হয়ে গেছে।
শিপার বিলাপে সেখানের পরিবেশ আদ্র হয়ে ওঠে। অন্য স্বজনরা চোখ মোছেন।
কিছুটা ধাতস্থ হবার পর আবার শিপা কথা বলতে থাকেন। বলেন, বাবা মাছ ব্যবসায়ী শিফর আলী, বোন তানজিনা আক্তার, দুই ভাই আল আমিন ও মুরাদ এবং বোনের ছেলে রনি একইসঙ্গে দগ্ধ হয়েছে।
কীভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটল জানতে চাইলে পাশে বসা চাচাতো ভাই ইমান আলী জানান, মুগদা মানিকনগর কুমিল্লাপট্টি এলাকার একটি বাসার দ্বিতীয় তলায় ভাড়া থাকেন তারা। বুধবার রাত সোয়া ১২টার দিকে বাসার ভেতর গ্যাস পাইপ লিকেজ থেকে আগুন ধরে ঘর বিদ্যুতায়িত হয়ে যায়।
এরপর সিলিং ফ্যান পুড়ে খুলে পড়লে ঘুমিয়ে থাকা সবাই দগ্ধ হন। ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. পার্থ শংকর পাল জানান, শিফর আলীর ২১ শতাংশ, আল আমিনের ১৭ শতাংশ, মুরাদের ৫৪ শতাংশ, তানজিনের ২৫ শতাংশ, এবং রনির ৬ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। রনি ছাড়া বাকিদের অবস্থা আশংকাজনক। এর মধ্যে মুরাদ রয়েছে আইসিইউতে, আল আমিন এবং শিফর আলী এইচডিইউতে (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) এবং বাকি দু’জন রয়েছেন পাঁচতলার সাধারণ ওয়ার্ডে।
ইমান আলী জানান, শিফর চাচার আরেক মেয়ের সন্তানের জন্ম হয় কয়েকদিন আগে। তাকে দেখতেই কুমিল্লা থেকে রনি এবং রনির মা রহিমা বেগম ঢাকায় আসেন। ছেলেটা (রনি) লেখাপড়ায় খুব ভালো, উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষার্থী। মুরাদ পড়ত সপ্তম শ্রেণিতে, এই ছেলেটাও লেখাপড়ায় খুব ভালো, খুব মেধাবী। দারিদ্রতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এই ছেলে দুটোকে নিয়ে আমাদের পুরো পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। আগুন কেবল এই পাঁচজনকে পোড়ায়নি, আমাদের পুরো পরিবারের স্বপ্ন পুড়িয়েছে।
সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ/এটি/এমএ