পদ্মা সেতুর আদলে যুবলীগের মঞ্চ, উপস্থিত থাকবেন শেখ হাসিনা
২৩ নভেম্বর ২০১৯ ০১:৫৭
ঢাকা: নানামুখী ষড়যন্ত্র-তৎপরতার পথ পেরিয়ে প্রমত্তা পদ্মা নদীর বুকে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে গোটা দেশের বহুল আকাঙ্ক্ষিত ও ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যতম মেগা প্রজেক্ট পদ্মা বহুমুখী সেতু। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যুবলীগও নানামুখী আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে সংগঠনটি ৭ম জাতীয় কংগ্রেসের দ্বারপ্রান্তে। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পদ্মা নদী না থাকলেও কিন্তু শৈল্পিক তুলির আঁচড়ে পদ্মা সেতুর আদলের প্রতিকৃতিতে প্রস্তুত করা হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের ৭ম জাতীয় কংগ্রেসের মূল মঞ্চ।
এবার তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত তাকিয়ে আছে সংগঠনের জাতীয় কংগ্রেসে শীর্ষ নেতৃত্বে কারা আসছেন? কেমন নেতৃত্ব সংগঠনের ভাবমূর্তির সংকট কাটিয়ে উঠে যুবলীগকে বাংলার প্রতিশ্রুত ও প্রগতিশীল নির্ভীকদের যুব ঠিকানা হিসাবে কেন্দ্র পর্যন্ত তৃণমূল অবধি প্রতিষ্ঠিত করবে, সেই অপেক্ষায় স্মার্ট নেতৃত্বের প্রহর গুণছে নেতাকর্মীরা। কারণ সরকারি দলের সহযোগী সংগঠন হিসাবে ক্ষমতার হাওয়ায় উড়তে গিয়ে অনেকে পদ-পদবী ব্যবহার করে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সংগঠনটির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা হয়েছে বলে এমনটাই জানিয়েছেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ অতিথি হিসাবে ভারতীয় যুব সমাজের একজন নেতাসহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের উপস্থিত থাকবেন। কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় কংগ্রেস প্রস্তুতির আহ্বায়ক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য চয়ন ইসলাম। সদস্য সচিব ও সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশিদ পরিচালনা করবেন। সম্মেলন মঞ্চে সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের নেতারা উপস্থিত থাকবেন। বাকিরা মঞ্চের সামনের প্যান্ডেলে নির্দিষ্ট আসনে বসবেন।
তবে বর্তমান কমিটির যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীসহ বাকি বিতর্কিত নেতাদের সম্মেলন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হয়নি।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকাল ১১টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হবে। এরপর বিকেলে রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক দুই শীর্ষ পদে নেতৃত্বের নাম ঘোষণা করা হবে। ইতোমধ্যে কংগ্রেস সফলের লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। সম্মেলনে ঘিরে বর্ণিল বা উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি না হলেও উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই নেতাকর্মীদের। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনস্থল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে পদপ্রত্যাশীদের পদচারণায় সরগরম হয়ে উঠেছে। ব্যানার-ফেস্টুনেও নিজেদের প্রার্থীতার আওয়াজ দিয়ে কংগ্রেসের সফলতা কামনা করেছে।
যুবলীগের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, প্রতিশ্রুতিশীল যুব নেতৃত্বের হাতেই সংগঠনের গুরুভার তুলে দেয়ার লক্ষ্যে এবার কংগ্রেসে যুবলীগের বয়সসীমা ৫৫ বছর করা হয়েছে। কংগ্রেসের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক চয়ন ইসলাম বলেন, ‘ইতোমধ্যে সব ডিজাইন, প্ল্যানিং হয়ে গেছে। কি রকম স্টেজ থাকবে, মঞ্চের ডিজাইন কি রকম থাকবে, মঞ্চটি একটি পদ্মা সেতুর অবয়বে করা হবে। তার ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে উপস্থিত থাকবেন।’ এছাড়াও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চমকসহ একটি দৃষ্টিনন্দন সম্মেলন উপহার দেওয়া হবে বলেও আশা করেন তিনি।
চয়ন ইসলাম জানান, কংগ্রেস উপলক্ষ্যে সারাদেশ থেকে প্রায় ২৫ হাজার ডেলিগেট আমন্ত্রিত এবং সাড়ে তিন হাজারের মত কাউন্সিলর উপস্থিত হবে। এছাড়াও সারাদেশ থেকে যুবলীগের প্রায় ৪০-৪৫ হাজার নেতাকর্মীর উপস্থিতি হবে বলেও প্রত্যাশা করেন তিনি।
যুবলীগ সম্প্রতি যে ইমেজ সংকটে পড়েছে নতুন যে কমিটি হবে সেটি ইমেজ সংকট কাটিয়ে উঠতে কতটুকু ভূমিকা রাখবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ থেকে দায়িত্ব পেয়েছি তখন থেকে আমার মনে হয় না যে, যুবলীগের কোন ইমেজ সংকট এখন পর্যন্ত বিদ্যমান আছে। সেটা ওভারকাম করা হয়েছে এবং আমরা যুবলীগের গতিতেই এগিয়ে চলেছি এখানে কোন ইমেজ সংকট এই মুহূর্তে নেই এবং আগামীতে তো থাকবেই না।’
এদিকে ১৮ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুবলীগের ৭ম কংগ্রেসের প্রস্তুতি উপলক্ষ্যে সম্মেলনস্থল ও মঞ্চ পরিদর্শনে আসেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য মির্জা আজম। মঞ্চ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পদ্মা সেতুর অবয়বে মূল মঞ্চ তৈরি করা হবে জানান নানক। তিনি বলেন, ‘এখানে যুবলীগের সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক, সদস্য সচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা রয়েছেন। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, যুবলীগ একটি নতুন আঙ্গিকে মঞ্চ তৈরি করছেন এবং সেই মঞ্চটি হচ্ছে যে, পদ্মা সেতুর উপরে বসে আছেন এমন অবয়ব, এমন আবহ থাকবে। অর্থ্যাৎ পদ্মা সেতুর ওপরে প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বসে আছেন।’
এদিকে, গত ২০ অক্টোবর গণভবনে যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে এক বৈঠকে আসন্ন কংগ্রেসে বয়সসীমা ৫৫ বছর এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য চয়ন ইসলামকে কংগ্রেস প্রস্তুতির আহ্বায়ক ও সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশিদকে সদস্য সচিব করে কংগ্রেস প্রস্তুতি কমিটি করা হয়।
তবে ধোঁয়াশা থাকা ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণ ও উত্তরের সম্মেলন সংগঠনের জাতীয় কংগ্রেসের পর অনুষ্ঠিত হবে। শুক্রবার (২২ নভেম্বর) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কংগ্রেস আয়োজনের প্রস্তুতি পরিদর্শন করতে এসে সাংবাদিকদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সম্মেলন ছাড়া উত্তর-দক্ষিণ কমিটি আমরা করব কীভাবে? আমরা আশা করছি, আমাদের জাতীয় কাউন্সিলের পর মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলন আয়োজন করবে যুবলীগের নতুন কমিটি। সেখান থেকেই নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুবলীগের নেতৃত্ব তাদের কাউন্সিলররা বাছাই করবেন। তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হবে। তাদের সম্মতিতে পরবর্তী নেতৃত্ব আসবে। এখানে অবশ্যই আমাদের অভিভাবক ও নেত্রী শেখ হাসিনার মূল্যবান পরামর্শ আমরা নেব নেতৃত্বের দ্বার উন্মোচনে। এখানে কে নেতা হবেন, এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। শনিবার কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনটি কাউন্সিল সেশন। সেখানে চেয়ারম্যান-সাধারণ সম্পাদকের নাম আহ্বান করা হবে। একাধিক করে প্রার্থী থাকলে তাদের মধ্য থেকে কাউকে নির্বাচিত করার জন্য সময় দেবো। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তারা নিজেরা কম্প্রোমাইজ করতে না পারলে উপস্থিত নেতাসহ আমাদের নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে নতুন কমিটির চেয়ারম্যান-সম্পাদকের নাম ঘোষণা করব।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, যুবলীগের শীর্ষ দুই পদের নেতৃত্ব সমন্বয়ে কেবল ভাবমূর্তিতে স্বচ্ছ নয়, রাজপথের নির্ভীক ও সাহসী নেতৃত্বের বিষয়টিও মাথায় রেখে নেতৃত্ব উপহার দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। কেন্দ্রীয় কমিটিতে এক ঝাঁক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গ্রহণযোগ্য যুবকদের নেতৃত্ব থাকবে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে। সেই ছকেই শনিবার (২৩নভেম্বর) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ নেতৃত্ব উপহার পেতে যাচ্ছে।
আসন্ন কংগ্রেসে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল মনির ছেলে শেখ ফজলে শামস (পরশ) চেয়ারম্যান হিসাবে নেতৃত্ব পাচ্ছেন, এটা নিশ্চিত। পরশ বর্তমান কংগ্রেসের নেতা নন। তিনি এতদিন শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত থেকে রাজনীতিক পরিবারের সন্তান হয়েও প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী রাজনীতির বাইরে ছিলেন। এর আগে কোনদিন তাকে যুবলীগের কোনো অনুষ্ঠানে সরব উপস্থিত দেখা যায়নি। কিন্তু শুক্রবার (২২ নভেম্বর) দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কংগ্রেসের প্রস্তুতি ও মঞ্চ পরিদর্শনের আওয়ামী লীগ নেতারাসহ সংগঠনের নেতাদের পাশে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের ছেলে পরশের উপস্থিত সাড়া ফেলে দেয়।
এদিকে গত মাসে ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে চলমান শুদ্ধি অভিযান শুরু করে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযানে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জেরে যুবলীগ নেতাদের নাম আলোচনায় উঠে আসে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে স্বাধীনতার সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনির হাতে গড়া সংগঠন যুবলীগ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী রাজনীতির রাজপথের ভ্যানগার্ড বলে পরিচিত সংগঠনটি। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে প্রায় প্রতিটি কংগ্রেসে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব পায়। আওয়ামী লীগ দল হিসাবে সরকারের বাইরে থাকার সময় রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে সংগঠনের ভ’মিকা ছিল নিঃসন্দেহে প্রশ্নাতীত। তবে বর্তমান কংগ্রেসের এবারের চিত্র ছিল একটু ভিন্ন। ক্ষমতাসীন সরকারের সহযোগী সংগঠন হিসাবে অনেকে বিতর্কিত ক্যাসিনো থেকে অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। এতে ইমেজ সংকটে পড়েছে সংগঠনটি। ঢাকা মহানগর থেকে শুরু করে সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকের বিরুদ্ধে ক্লাব পরিচালনার আড়ালে অবৈধ জুয়া ব্যবসার অভিযোগ উঠেছে। এমন অভিযোগে সংগঠনের প্রভাবশালী নেতাদের কেউ কেউ আইনশৃংখলারক্ষা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। কেউ কেউ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির অভিযোগে বহিষ্কারও হয়েছেন। আবার অনেকে এখনও রয়েছেন গ্রেফতার আতঙ্কে।
এর আগে, যুবলীগের সর্বশেষ কংগ্রেস হয় ২০১২ সালের ১৪ জুলাই। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান বঙ্গবন্ধুর পরিবারের আত্মীয় ওমর ফারুক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক হন হারুন-অর-রশিদ। ওমর ফারুক চৌধুরী শেখ মনি এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বোন জামাই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুবলীগের ছয়টি জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে চারটিতে চেয়ারম্যান ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি, কমিটিতেও ছিল তার নিকটাত্মীয়দের আধিক্য। তাই যুবলীগের প্রতিটি সম্মেলনেই প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের পরিবারের কেউ না কেউ আলোচনায় আসেন।