মহারাষ্ট্রে ‘পাওয়ার’ প্লে
২৩ নভেম্বর ২০১৯ ১৫:১০
ভারতের মহারাষ্ট্রে কারা সরকার গঠন করবে এই নিয়ে নাটকীয়তা চলছে বহুদিন ধরেই। প্রতিনিয়ত সেই নাটক নিচ্ছে নয়া মোড়। সর্বশেষ নাটককে মহানাটকে পরিণত করলেন রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতে স্ট্রংম্যান খ্যাত শারদ পাওয়ারের ভাতিজা অজিত পাওয়ার। এনসিপির এই নেতা সকল হিসাব উল্টে দিয়ে অনেকটা ভোরের আলো-আঁধারীতে বিজেপির সাথে হাত মেলান।
অক্টোবরের ২৪ তারিখ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর দেখা যায় সরকার গঠনের জন্য কোনও দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সেই থেকে জটিলতার শুরু। সেই জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দল শিবসেনার অনড় অবস্থান। নির্বাচনে একক দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ১০৫টি আসনে জেতে বিজেপি। অন্যদিকে তাদের রাজনৈতিক মিত্র তথা নির্বাচনের জোট সঙ্গী শিবসেনার ঘরে আসে ৫৬টি আসন। দুই দলের মিলিত আসন সংখ্যা মহারাষ্ট্রে সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট। ২৮৮ আসনের মহারাষ্ট্রে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১৪৫ আসন।
কিন্তু সমস্যা বাঁধে মূখ্যমন্ত্রী পদ নিয়ে শিবসেনার অনড় অবস্থানের কারণে। শিবসেনা দাবি করে নির্বাচনের আগে দেওয়া ৫০ঃ৫০ ফর্মূলা মেনে মূখ্যমন্ত্রী পদে দুই দল থেকে দুজন আড়াই বছর করে দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু শিবসেনার এই দাবিতে সায় দেয়নি বিজেপি। এ নিয়ে প্রায় তিন দশকের মিত্র বিজেপি আর শিবসেনার মধ্যে দ্বন্দ্বের শুরু। দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট থেকে বেরিয়ে আসে শিবসেনা। এমনকি পদত্যাগ করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় থাকা শিবসেনার মন্ত্রীও।
একদিকে মূখ্যমন্ত্রী প্রশ্নে শিবসেনার অনড় অবস্থান, অন্যদিকে বিজেপির ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা- এই দুইয়ের জোরদার হাওয়ায় আসরে চলে আসে রাজ্যের আরেক গুত্বপূর্ণ দল শরদ পাওয়ারের এনসিপি (ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি) এবং কংগ্রেস। নির্বাচনে কংগ্রেস-এনসিপি জোট পায় ৯৮টি আসন (কংগ্রেস ৪৪, এনসিপি ৫৪)। বিজেপি আর শিবসেনার দূরত্ব শিবসেনার কাছাকাছি আনে কংগ্রেস আর এনিসিপিকে। যদিও রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক দিয়ে তারা পরস্পর বিপরীত মেরুর। তারপরও বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে শিবসেনার হাত ধরতে রাজি হয় কংগ্রেস ও এনসিপি। উল্টে যেতে থাকে ক্ষমতায় যাবার সমীকরণ।
প্রথম দিকে কিছুটা দ্বিধা কাজ করলেও পরবর্তিতে কংগ্রেস সুপ্রিমো সোনিয়া গান্ধিও শিবসেনাকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হন। সরকার গঠনের নয়া মেরুকরণে উঠে আসে তিন দলের নাম- শিবসেনা, এনসিপি ও কংগ্রেস। মাঝে মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল বিজেপিকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানালে তিনদিন সময় পেয়েও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যা জোগার করতে ব্যর্থ হয় তারা। একইভাবে ব্যর্থ হয় শিবসেনা এবং এনসিপি। কারণ তখন পর্যন্ত প্রচণ্ড রকমের হিন্দুত্ববাদী শিবসেনার সাথে জোট করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কংগ্রেস। এরমধ্যে ১২ নভেম্বর থেকে রাজ্যে ছয় মাসের জন্য রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়ে যায়।
রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হওয়ার পর কিছুটা নড়েচড়ে বসে কংগ্রেস। তাদের সক্রিয় হওয়ার আরেক কারণ এনসিপি প্রধান তথা কংগ্রেস মিত্র শারদ পাওয়ারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক। রাজনৈতিক মহলে চাউর হয়, এনসিপিকে হাতে আনতেই শারদ পাওয়ারের সাথে বৈঠক করেছেন মোদি। এমনকি এমন কথাও শোনা যায় শারদকে রাষ্ট্রপতি করার আশ্বাস দিয়ে নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায় করে নিয়েছে নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি।
কংগ্রেস নড়েচড়ে বসায় শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস এর জোট সরকার গড়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। শেষ কয়েক দিনে যা চূড়ান্ত অবস্থায় চলে আসে। ২২ নভেম্বর এই তিন দলের যৌথ সভা থেকে ঘোষণা আসে মহারাষ্ট্রে শিবসেনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে এনসিপি ও কংগ্রেস। যার মূখ্যমন্ত্রী হবে শিবসেনা প্রধান উদ্ভব ঠাকরে। ২৩ নভেম্বর (শনিবার) যার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। এদিনই তারা রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের কাছে সরকার গঠনের আবেদন করবেন বলেও শোনা যায়।
শুক্রবার রাত পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু শনিবার সকালেই উল্টে-পাল্টে যায় সব। মহারাষ্ট্র তথা ভারতের রাজনীতিবিদদের ঘুম ভাঙ্গে বিস্ময়কর এক খবরে- শনিবার কাক ডাকা ভোরে মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন করে ফেলেছে বিজেপি। সেই সরকারের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন দেবেন্দ্র ফড়নবীশ। আর উপ মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার হাত ধরেছেন এনসিপির মহারাষ্ট্র রাজ্য প্রধান তথা শারদ পাওয়ারের ভাতিজা অজিত পাওয়ার। অজিত পাওয়ার দাবি করেছেন এনসিপির বিধায়করা তার সঙ্গে আছেন।
ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য ধারণা করছিলেন অজিতের পেছনে বসে মূল কল-কাঠি আসলে নাড়ছেন শারদ পাওয়ার। এমন ভাবনার পেছনে অবশ্য নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার সাম্প্রতিক বৈঠককেই বড় কারণ ধরা হচ্ছিল। কিন্তু দিনের আলো যত পরিষ্কার হয় ততই স্পষ্ট হতে থাকে আসল চিত্র। সাংবাদিক বৈঠক ডেকে শারদ পাওয়া দাবি করেছেন, অজিত পাওয়ারের এমন সিন্ধান্তের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না তিনি। একই সঙ্গে অজিত পাওয়ারের সঙ্গে শপথ অনুষ্ঠানে যাওয়া দলের কয়েকজন বিধায়ককেও সাংবাদিক বৈঠকে হাজির করেন তিনি। যারা দাবি করেছেন অজিত তাদের বিভ্রান্ত করেছেন। তারা শারদ পাওয়ারের নেতৃত্বেই আছেন।
তাহলে কি হতে যাচ্ছে মহারাষ্ট্রের নতুন এই সরকারের ভবিষ্যত? শারদের সাংবাদিক সম্মেলনে থাকা শিবসেনা প্রধান উদ্ভব ঠাকরে বলেন, ‘বিধায়ক কেনা-বেচা বিজেপির পুরনো অভ্যাস। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো রাতের আঁধারে ভারতের গণতন্ত্রের ওপরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছে তারা। তবে তারা সফল হবে না। কারণ কংগ্রেস-শিবসেনা-এনসিপি আমরা একজোট আছি এবং মহারাষ্ট্রে আমরাই একটি স্থিতিশীল সরকার গঠন করবো। বিধানসভার ফ্লোর টেস্টে ভূপাতিত হবে বিজেপি-অজিতের অপরিণত কূটকৌশল।’
শারদ পাওয়ারের দাবিও তেমনটাই। তিনি বলছেন, দলের ৫৪ বিধায়কের সিংহভাগই তার নেতৃত্বে আস্থাশীল।
ওদিকে শুধু অজিত পাওয়ারকে দিয়ে বিজেপির হবে না। ক্ষমতায় থাকতে হলে অজিতের সংগে এনসিপির কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ বিধায়ককে থাকতে হবে। অজিত পাওয়ারের পক্ষে কি দলের এত সংখ্যক বিধায়ক ধরে রাখা সম্ভব?
অন্যদিকে দলছুট অজিত পাওয়ারের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেবেন শারদ পাওয়ার? শারদ বলছেন এ ব্যাপারে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে চান তিনি। আর এজন্য তিনি সামান্য কিছু সময় চেয়ে নিয়েছেন।
সময় হয়তো কিছুটা তিনি পাবেন। আর ততক্ষণ পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে চলতে থাকবে ‘পাওয়ার প্লে’।
অজিত পাওয়ার উদ্ভব ঠাকরে এনসিপি কংগ্রেস দেবেন্দ্র ফড়নবীশ পলাশ মাহবুব বিজেপি ভারত মহারাষ্ট্র রাজনীতি শারদ পাওয়ার শিবসেনা সোনিয়া গান্ধী