Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বন ছেড়ে হাতি কেন লোকালয়ে?


২৫ নভেম্বর ২০১৯ ০৭:৫০

চট্টগ্রাম ব্যুরো: গত দুই বছর ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বারবার পাহাড় ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসছে হাতি। সেসব এলাকাগুলোতে আসছে, যেখানে আগে কখনো হাতির এমন বিচরণ দেখা যায়নি। হাতির আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ।

বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, তিন কারণে বন ছেড়ে হাতি এখন লোকালয়ে চলে আসছে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল তৈরির জন্য কক্সবাজারের ‘হাতির অভয়ারণ্য’ বন-জঙ্গল কেটে সাফ করা হয়েছে। যে কারণে হাতির আবাস ও চলাচলের জায়গা সংকুচিত হয়ে গেছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় ও স্থলমাইন স্থাপনের কারণে হাতি মিয়ানমারে যেতে পারছে না এবং বন-জঙ্গলে হাতির খাদ্যের ব্যাপক অভাব দেখা দিয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, হাতিকে পাহাড়ে রাখার পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে কিংবা তার চাহিদা মেটাতে না পারলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের পাহাড়ের নিকটবর্তী আরও বিভিন্ন এলাকা আক্রান্ত হবে, যেখানে অতীতে কখনো হাতির বিচরণ দেখা যায়নি।

আর হাতির আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর জন্য সনাতন পদ্ধতিতে হাতি তাড়ানোর কৌশল, কৌতুহলী জনতার অতি উৎসাহী আচরণ এবং সচেতনতার অভাবকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

১৯৮৩ সালে মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের ১১ হাজার ৬১৫ হেক্টর বনকে বন্যপ্রাণী বিশেষ করে এশিয়ান হাতির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। বন বিভাগের হিসাবে টেকনাফের অভয়ারণ্যে ৬৪টি হাতি আছে। অন্যদিকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্য হাতির চলাচলের করিডোর হিসেবে ১৯৮৬ সালের কক্সবাজারের চকরিয়া এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলার ৭৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয় চুনতি অভয়ারণ্য, যেখানে ৬০টির মতো হাতি আছে বন বিভাগের মতে। এর বাইরে বান্দরবানের লামা, রাঙামাটির কাপ্তাইসহ বিভিন্ন পাহাড়ে হাতির আবাসস্থল আছে।

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, বাঁশখালী, বোয়ালখালী, রাঙামাটির কাপ্তাই, বান্দরবানের লামাসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই পাহাড় থেকে হাতি লোকালয়ে আসছে। ঘরবাড়ি-ফসলের ক্ষেত ধ্বংস করছে, পাশাপাশি মানুষের ওপরও আক্রমণ করছে হাতি।

গত সপ্তাহেও হাতির পাল চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামের ভেতরে ঢুকে পড়ে। সর্বশেষ রোববার (২৪ নভেম্বর) চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় হাতির আক্রমণে মারা যান তিনজন।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ সারাবাংলাকে জানান, ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত হাতির আক্রমণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় মারা গেছেন ৪৫ জন। এর মধ্যে গত দুই বছরে মারা গেছেন ১৬ জন। ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এসব এলাকায় লোকালয়ে এসে ৮৮টি হাতি মারা পড়েছে। তবে সেসময় হাতি লোকালয়ে আসত বছরে হাতেগোণা দু’তিনবার। গত দু’বছরে লোকালয়ে হাতি এসেছে কমপক্ষে অর্ধশতবার।

লোকালয়ে হাতি প্রবেশের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া নিয়ে গবেষণা করেছেন বন্যপ্রাণী গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ এইচ এম রায়হান সরকার। তিনি সারাবাংলাকে জানান, ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ের বন কেটে উজাড় করা হয়েছে। হাতি চলাচলের পথ নষ্ট করা হয়েছে। হাতির আবাসস্থলের ওপর এমন আঘাত অতীতে আর কখনোই হয়নি। এছাড়া মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় হাতিগুলোর সেখানে প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেছে। সীমান্তে স্থলমাইন স্থাপনের কারণে সেই করিডোর ব্যবহার করছে না হাতির পাল। আবাসস্থল এবং মিয়ানমারে প্রবেশের সুযোগ হারিয়ে টেকনাফ থেকে হাতিগুলো এসেছে চুনতি অভয়ারণ্যে।

আমার হিসেবে ২০১৬ সালে টেকনাফে ৩৫টির মতো হাতি ছিল। চুনতিতে আছে ৪০-৫০টি। রোহিঙ্গারা যখন হাতির আবাস ধ্বংস করা শুরু করল, তখন কিছু হাতি মিয়ানমারের দিকে চলে গেছে। কিন্তু মিয়ানমার যখন সীমান্তে ল্যান্ডমাইন বসায়, হাতির অনুভূতি শক্তি তো খুব প্রখর, তারা আর মিয়ানমারের দিকে যায়নি। পরে তো মিয়ানমার বেড়া দিয়ে করিডোরই বন্ধ করে দিলো। এরপর টেকনাফে যে কয়টা হাতি ছিল, সেগুলো চলে এসেছে চুনতিতে। এখন চুনতিরও তো একটা ধারণক্ষমতা আছে। এত হাতির ভার তো সে সহ্য করতে পারছে না। ফলে বাঁচার তাগিদে হাতিগুলো ছড়িয়ে পড়ছে— বলেন রায়হান সরকার।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এই অঞ্চলের হাতিগুলোর দীর্ঘদিনের অভ্যাস হচ্ছে, তারা ঘুরে ফিরে থাকে। বছরের নির্দিষ্ট সময় তারা মিয়ানমারে যায়, সেখানে থাকে। এরপর আবার কক্সবাজারের টেকনাফে, লোহাগাড়ার চুনতিতে ফিরে আসে। সেখান থেকে আবার পার্বত্য অঞ্চলে যায়। মিয়ানমারের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই হাতিগুলো এখন চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া এমনকি পাহাড়ি পথে বোয়ালখালী পর্যন্ত চলে আসছে। বোয়ালখালীতে আমরা যেটা জেনেছি, পাহাড় ছেড়ে ১২ কিলোমিটার ভেতরে দূরে গ্রামের মধ্যে চলে এসেছে। দিন যতই যাবে, হাতিগুলো আরও বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে। কারণ তাদের তো বাঁচতে হবে।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, একটি হাতি একবার হাঁটা শুরু করলে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার হাঁটতে পারে এবং এটা তাদের অভ্যাস। পাহাড়ে এখন এত হাঁটার জায়গা কোথায়? তো, তারা যাবে কোথায়? পাহাড় ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকালয়ে চলে আসছে।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্ম্মা সারাবাংলাকে বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৮ হাজার একর বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। এর ফলে এশিয়ান হাতিগুলোর চলাচল ২০০-৩০০ একর জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। হাতির খাদ্যচক্র ধ্বংস করা হয়েছে। সুতরাং তারা থাকবে কেন? হাতিগুলো এখন প্রায়ই টেকনাফের হ্নীলা, উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় নেমে আসছে। রামু এমনকি হিমছড়িতে পর্যন্ত হাতি আসছে, যা আমরা অতীতে কখনো দেখিনি।

রায়হান সরকার আরও বলেন, হাতি পাহাড়ে খাবার পাচ্ছে না। সেখানে বনায়নের সময় যেসব গাছ লাগানো হয়, সেগুলো হাতির খাদ্য না। আবার হাতির খাদ্য হিসেবে গাছ লাগানো হলেও সেগুলো তো আর দিনে দিনে বড় হচ্ছে না। পাহাড়ের গাছপালাও সাবাড় করা হচ্ছে। একদিকে হাতি বেড়ে গেছে, অন্যদিকে খাবার কমেছে। তাই তারা পাহাড় থেকে পাকা ধান কিংবা তাদের খাবার দেখলেই ছুটে আসছে।

পাহাড়ের খাদ্যের অভাবের বিষয়টি মানতে নারাজ বিভাগীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তা আবু নাসের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, এটা তো গবেষণার বিষয়। তাহলে আমরা প্রতিবছর যে এত গাছ লাগাচ্ছি, হাতি না খেলে সেগুলো যাচ্ছে কোথায়? একটি পূর্ণবয়স্ক হাতি দিনে ১৫০ থেকে ২০০ কেজি খাবার গ্রহণ করে। আমাদের পাহাড়গুলোর এত খাবারের যোগান দেওয়ার সক্ষমতা আছে কি না সেটাও তো দেখতে হবে।

হাতির আক্রমণে মৃত্যুর জন্য মানুষের অসচেতনতাই প্রধানত দায়ী বলছেন চবি শিক্ষক ও বন কর্মকর্তা।

বন কর্মকর্তা আবু নাসের বলেন, হাতি দেখলেই হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে যায়। হাতির মুভমেন্ট যে স্বাভাবিক বিষয়, এটা মানুষ বুঝতে চায় না। হাতিকে বিভিন্নভাবে ডিস্টার্ব করে। নানাভাবে শব্দ করে। হাতি তাড়ানোর জন্য আমাদের নিজস্ব বিভিন্ন কৌশল আছে। কিন্তু অতি উৎসাহী লোকজনের জন্য সেটা আমরা করতে পারি না। মানুষ যেন আত্মহত্যা করার জন্যই হাতির কাছে যায়।

বোয়ালখালীতে তিনজনের মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা আমাদের কৌশল প্রয়োগ করে হাতিগুলোকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করছিলাম। কিন্তু মাঠে পাকা ধান থাকায় হাতিগুলো দ্রুত মুভ করছিল। যারা মারা গেছেন, তারা নিশ্চয় জানতেন যে এলাকায় হাতির পাল ঢুকেছে। একটু সতর্কভাবে চলাফেরা করা, ধানক্ষেতে যাওয়ার আগে হাতির বিষয়টা বিবেচনা করা তাদের দরকার ছিল।

চবি শিক্ষক রায়হান সরকার বলেন, লোকালয়ে যেসব হাতি আসে, সঙ্গে তাদের সন্তানও থাকে। সন্তান যখন থাকে তখন মা হাতিরা খুব সেনসেটিভ থাকে। মানুষজন যখন নানা ধরনের শব্দ করে, জড়ো হয়ে চিৎকার করে, তখন মা-হাতি ভাবে সন্তানের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। তখন তারা উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তবে হাতি তাড়ানোর জন্য এই মুহুর্তে বন বিভাগের কাছেও তেমন কোনো কৌশল নেই। সনাতন পদ্ধতিই সম্বল। এজন্য এলিফেন্ট রেসকিউ টিম গঠন করা জরুরি। যদিও ব্যয়বহুল, কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার জরুরি।

লোকালয়ে হাতি হাতির অভয়ারণ্য


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর