‘পুলিশের সক্ষমতা বাড়ায় কোণঠাসা জঙ্গিরা’
২৬ নভেম্বর ২০১৯ ১৯:৪০
ঢাকা: বহুল আলোচিত হলি আর্টিজান হামলার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সারাবিশ্বে জানান দিয়েছিল জঙ্গিরা। দেশে বিভিন্ন সময় জঙ্গিবাদী তৎপরতা থাকলেও ওই হামলায় ১৭ বিদেশির মৃত্যু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের খবর পৌঁছে দেয়। এরপর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। ক্রমান্বয়ে জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদী তৎপরতা প্রতিরোধে সক্রিয় হতে থাকে তারা। জঙ্গিবাদবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এর ফলে ওই হামলার পরবর্তী তিন বছরে জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এ কারণে জঙ্গিরাও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় প্রাণঘাতী হামলা চালায় জঙ্গিরা। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিদের আনাগোনা বেশি থাকার কারণে হামলার জন্য ওই রেস্তোঁরাটিকেই বেছে নেয় তারা। ইতালির ৯, জাপানের সাত ও এক ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যু তাদের সেই উদ্দেশ্য পূরণও করে। তবে এই হামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতরাও ছাড় পায়নি। হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি ঘটনাস্থলেই কমান্ডো টিমের অভিযানে মারা যায়। হামলায় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া মূল হোতাদের মধ্যে তামিম চৌধুরী, মেজর (চাকরিচ্যুত) জাহিদ ও অন্যতম মাস্টারমাইন্ড মারজানসহ আরও আট জনের মৃত্যু হয় বিভিন্ন সময় পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে। নৃশংস সেই হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে আগামীকাল বুধবার (২৭ নভেম্বর)।
আরও পড়ুন- যেভাবে রায়ের পর্যায়ে পৌঁছালো হলি আর্টিজান মামলা
এদিকে, হলি আর্টিজানে হামলায় হামলাকারীরা ঘটনাস্থলেই মারা গেলেও এর পৃষ্ঠপোষকরা বসে থাকেনি। বরং দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা জঙ্গি তৎপরতা ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। তবে তাদের সেই তৎপরতায় লাগাম টেনে ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তা। একের পর এক দেশের বিভিন্ন স্থানে খুঁজে বের করা হয় জঙ্গি আস্তানা। অভিযানে প্রাণ হারান অনেক জঙ্গি নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন অনেকে। পুলিশ-র্যাবসহ গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর সার্বিক তৎপরতায় অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে জঙ্গিরা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার পর পুলিশের সক্ষমতা অনেক দিক থেকেই বেড়েছে। বিশেষ করে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স ঘোষণা জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মকাণ্ডে নতুন গতি এনে দেয়। সরকার একদিকে যেমন দেশবাসীকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একজোট করেছে, তেমনি জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশকে সক্ষমতা অর্জনের জন্য বাজেটও দিয়েছে। ফলে পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, নতুন যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, ফরেনসিক ল্যাব তৈরি করা হয়েছে, সাইবার ক্রাইম রুখতেও যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করে তুলতে বহুমুখী প্রচারণা চালানো গেছে। এছাড়া সোয়াতকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, পুলিশের সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার কারণে জঙ্গিবাদী তৎপরতা কমেছে। ২০১৮ সালের পর জঙ্গি হামলার ঘটনাও কমে এসেছে। তবে উগ্রবাদী প্রবণতা কিছুটা বেড়েছে। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জঙ্গি নেতারা নিহত বা আটক হলেও তারা যাদের জঙ্গিবাদে দীক্ষিত করেছে, সেই তরুণদের অনেকে এখনো বাইরে আছে। তবে ক্যারিশম্যাটিক কোনো নেতার অভাবে তাদের তৎপরতা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অথবা জঙ্গি চ্যানেলগুলো দেখলে বোঝা যায়, উগ্রবাদ বা র্যাডিকেলাইজেশন কী পরিমাণে বাড়ছে। কিছু ঘটলেই উগ্রপন্থী মনোভাব প্রকাশ করতে দেখা যায় অনেককেই। তা সত্ত্বেও র্যাডিকেলাইজেশনের এই প্রবণতার থেকে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদে রূপ নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ পুলিশ সবসময় নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। তাদের নেটওয়ার্ক যেন সক্রিয় হতে না পারে, সেজন্য কাজ চলছে।
মনিরুল ইসলাম বলেন, ভবিষ্যতে যেন এ দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য সারাদেশেই বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, জনপ্রতিনিধি, সরকারি চাকরিজীবী, আলেম-ওলামা, ডিসি-এসপি সবারই উপস্থিতি থাকে। এছাড়া ঢাকাসহ সারাদেশের পুলিশ ও কারারক্ষীদের নিয়ে আলাদাভাবে জঙ্গিবিরোধী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা সহজেই জঙ্গি সম্পর্কে বুঝতে পারে।
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, গত তিন বছরে প্রায় সাড়ে ৯০০ জঙ্গি কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে চারশ জঙ্গি ধরা পড়ে ২০০৪ সালের দিকে। তাদের অনেকের সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছিল। জামিনে মুক্ত হওয়া জঙ্গিদের নজরদারি করা হলেও অনেকেই ফের জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক জঙ্গির কোনো কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ নেই। এ কারণে মুক্ত হওয়া জঙ্গিরা কোথায় কী করছে, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, জামিনে মুক্ত জঙ্গিদের মধ্যে সিটিটিসির পক্ষ থেকে পুনর্বাসন করতে ৪২ জনের নাম সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ২২ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ২২ জনের আট জনের আর্থিক সমস্যা ছিল। বাকিদের আর্থিক সমস্যা না থাকলেও তারা জানান, সমাজে তাদের ঘৃণা করা হয়। সমাজের লোকজন তাদের বিশ্বাস করতে চায় না। একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা। সব মিলিয়ে সমাজের মূল স্রোতে তারা যেন মিশতে পারে, সে চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষা, সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ— এই তিনটি থাকলে উগ্রবাদ রুখে দেওয়া সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বর্তমানে জঙ্গিদের সক্ষমতা নিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালের আগে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক মোটামুটি শক্তিশালী ছিল। তারা ইচ্ছা করলে যেখানে সেখানে হামলাও চালিয়েছে। তবে ২০১৮ সালের পর একমাত্র পুলিশের ওপর পাঁচটি হামলা ছাড়া আর কোনো হামলা চালাতে পারেনি। নব্য জেএমবির একটি সেল গঠন করে এই হামলা চালানো হয়েছিল বলে আমরা পরে জানতে পেরেছি। কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জে সেই সেলের আস্তানাটিও ধ্বংস করেছি। ওই সেলের তিন জন এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। বাকি দু’জনের ছবি ও নাম পাওয়া গেছে। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, নব্য জেএমবির কোনো সদস্য এই মুহূর্তে সক্রিয় না থাকলেও পুরনো ধারার জেএমবির কিছু সদস্য আন্তর্জাতিক আল-কায়দার আদলে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। সেটিও গোয়েন্দা নজরদারির কারণে ভেস্তে যাচ্ছে। তারা দুর্গম অঞ্চলে মাদরাসা বা ধর্মীয় কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেখানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ার চেষ্টা করছে। তবে গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন যেভাবে কাজ করছে, তাতে উগ্রবাদীদের এই প্রচেষ্টাও সফল হবে না।
উগ্রবাদ জঙ্গিবাদ পুলিশের সক্ষমতা হলি আর্টিজান হলি আর্টিজান হামলা হলি আর্টিজান হামলা মামলা