শেয়ার বিক্রি নিয়ে মতবিরোধ, অস্থিরতা পুঁজিবাজারে
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৪:০৪
গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা : অভিহিত মূল্যের বিপরীতে শেয়ার কার কাছে বিক্রি করা হবে তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও বাংলাদেশ সিকিরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)’র মধ্যে। অভিহিত মূল্যের সর্বোচ্চ দরের বিপরীতে ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি নিয়ে ওই দুই সংস্থার মধ্যে মতবিরোধ। যা নিয়ে পুঁজিবাজারে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।
সূত্র জানিয়েছে, ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করতে চাইছে ডিএসই। চীনের পুঁজিবাজার সংস্থা শেনজেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ারপ্রতি দাম দিতে চাইছে ২২ টাকা। যা অভিহিত মূল্যের বিপরীতে সর্বোচ্চ দাম। ফলে ডিএসই সিদ্ধান্ত নেয় চীনের দুই সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামের কাছে বিক্রি করা হবে উল্লিখিত ২৫ শতাংশ শেয়ার।
অপরদিকে চীনা শেয়ারবাজার সংস্থার প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ারের দাম দিতে চাইছে ১৫ টাকা করে। সেক্ষেত্রে ভারতের দাম চীনের দামের থেকে শেয়ারপ্রতি ৭ টাকা কম। তারপরও ভারতের কাছে শেয়ার বিক্রির জন্য ডিএসইকে চাপ দিয়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
দুই সংস্থার বিদ্যমান মতবিরোধ প্রভাব ফেলেছে লেনদেনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ২৯ জানুয়ারি ঘোষিত মুদ্রানীতি কেন্দ্র করে পুঁজিবাজারে আগে থেকেই অস্থিরতা চলছিল। মুদ্রানীতি নীতির পর ডিএসইর শেয়ার বিক্রি নিয়ে নতুন করে আরেক দফায় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
মুদ্রানীতির প্রভাবে গত ২৫ জানুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লেনদেন হওয়া ১০ কার্য দিবসের মধ্যে ৭ দিনই শেয়ারের দরপতন হয়েছে। এ সময়ে ডিএসই বাজার মূলধন হারিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা, সূচক কমেছে ২৫০ পয়েন্ট। শেয়ার বিক্রির সুখবরে রোববারও পুজিবাজারে বড় ধরনের উত্থান হয়। কিন্তু শেয়ার বিক্রি নিয়ে মতবিরোধে সোমবার পুঁজিবাজারে আবারও নিম্নমুখি হয়। পরের দুইদিন মঙ্গল ও বুধবার দিনভর সূচকের ব্যাপক উঠানামার পর দিনশেষে বাজার কিছুটা ঊর্ধমুখী থাকলেও বৃহস্পতিবার পুনরায় বড় দরপতন হয়। মূলত চীনের কোম্পানির পরিবর্তে কঠিন শর্তে এবং কম দামে ভারতীয় কোম্পানিকে শেয়ার দেয়ার খবরে পুঁজিবাজারের এ অস্থিরতা বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
ডিএসই সূত্র জানায়, গত ১০ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর বোর্ড সভায় চীনের কনসোর্টিয়ামের কাছে শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। চীনের সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ এবং শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জকে নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামটি ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী হতে চায়। এজন্য তারা ডিএসইর ২৫ শতাংশ শেয়ার ২২ টাকা দামে কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে। অর্থাৎ ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ডিএসইর প্রতিটি শেয়ার ২২ টাকা দরে মোট ৯৯২ কোটি টাকার শেয়ার কিনতে প্রস্তাব দেয় কনসোর্টিয়ামটি। পাশাপাশি এ কনসোর্টিয়ামটি ৩৭ মিলিয়ন ডলারের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে।
অন্যদিকে ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের (এনএসই) নেতৃত্বাধীন জোট ডিএসইর প্রতিটি শেয়ার ১৫ টাকা দরে মোট ৬৭৬ কোটি টাকা দিতে চেয়েছে। এছাড়াও আগামী ৫ বছরের মধ্যে যে কোনো প্রক্রিয়ায় তাদের বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়। এছাড়াও পর্ষদে মোট দু’জন সদস্য থাকার প্রস্তাব করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু আইনে আছে কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মাত্র একজন সদস্য রাখা যাবে। ডিএসইর বোর্ড ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব ডিএসইর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ও আইনসিদ্ধ না হওয়ায় চীনের প্রস্তাব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সূত্র জানায়, চীনের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে শেয়ার বিক্রির খবর পেয়ে ঢাকায় আসেন ভারতের অন্যতম শেয়ারবাজার ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিক্রম লিমা। গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিক্রম লিমা ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাজেদুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রি করতে বিক্রম লিমা ডিএসইর কর্মকর্তাদেও চাপ প্রয়োগ করেন বলে জানা গেছে। তা সত্ত্বেও ডিএসই বিক্রম লিমার প্রস্তাব অন্যায় ও অযৌক্তিক বলে তা প্রত্যাখান করে।
সূত্র জানায়, ডিএসই‘র শেয়ার বিক্রি ইস্যুতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি সরাসরি ভারতের পক্ষে অবস্থান নেয়। এসইসি ১১ ফেব্রুয়ারি বিকালে ডিএসইর চেয়ারম্যান ও এমডিকে ডেকে নিয়ে চীনের পরিবর্তে ভারতীয় কোম্পানির কাছে শেয়ার বিক্রির জন্য চাপ দেয়। ডিএসই অনড় অবস্থানে থাকায় বিএসইসি অবস্থান বদল করে ভারত ও চীন উভয় দেশের কাছে শেয়ার বিক্রির জন্য নতুন করে চাপ দেয়। বিপরীতে ডিএসইর মেম্বাররা এখনও শুধু চীনের কাছে শেয়ার বিক্রির অবস্থানে অনঢ় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, যে কোন কন্টাক্টের ক্ষেত্রে দুটো জিনিস দেখতে হবে। একটি হল যাকে দিচ্ছি তা টেকনিক্যাল দক্ষতা কেমন, দ্বিতীয়ত হল আর্থিক দরটা কেমন দিচ্ছে। এইক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে চীনের প্রতিষ্ঠান অনেক বেটার। কারণ চীন ডিএসইর প্রতিটি শেয়ার ২২ টাকা প্রস্তাব করেছে আর ভারতীয় প্রতিষ্ঠান করেছে ১৫ টাকা। এছাডাও চীন আরো কিছু ভাল প্রস্তাব দিয়েছে, যা ভারত দেয়নি। ফলে এই ক্ষেত্রে বিএসইসির কোনো অবস্থান নেওয়া উচিত না।
ডিএসইর বর্তমান পরিচালক ও সাবেক সভাপতি মো. রকিবুর রহমান বলেন, ডিমিউচুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী যারা শর্ত পরিপূর্ণ করছে তাদেরকেই দিতে হবে। চীন আমাদের দরপত্রের শর্ত পরিপালন করেছে, আমরা তাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটাই শেষ কথা।
তিনি বলেন, চীন ও ভারতের প্রস্তাব চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখছি, একটি দেশ খাপছাড়া প্রস্তাব করেছে। আরেকটি জেনুইন প্রস্তাব করেছে। ফলে একটির সঙ্গে আরেকটির তুলনায় হয় না।
তিনি বলেন, ভারতীয় কোম্পানি ৫ বছরের মধ্যে আইপির মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করার অনুমতিসহ অনেক শর্ত দিয়েছেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে সব দিক বিবেচনায় চীনা কোম্পানি এগিয়ে রয়েছে। স্টক মার্কেটের স্বার্থে আমরা চীনা প্রতিষ্ঠানকে শেয়ার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।
অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)‘র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখাররুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে এসইসি’র অনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির প্রচেষ্টা দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। রক্ষক হয়ে এসইসি ভক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে না; তাও দরদাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগসাজসে বা প্রভাবান্বিত হয়ে।’
তিনি আরো বলেন, ‘দর প্রস্তাব মূল্যায়নে প্রায় অর্ধেক পিছিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের তদবির ও চাপ প্রয়োগ যেমন নজিরবিহীন তেমনি আইনবিরুদ্ধ। বিএসইসি কর্তৃক তাতে প্রভাবিত হয়ে বাছাই প্রক্রিয়াকে কলুষিত করে অযোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে ইন্ধন যোগানো বেআইনি ও অগ্রহণযোগ্য।’
এ ব্যাপারে বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিএসইর শেয়ার বিক্রি বিষয়ে আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করিনি। এখনো আমাদের কাছে ডিএসইর কোনো প্রস্তাব আসেনি। এলে তখন বিষয়টা দেখব।’
সারাবাংলা/জিএস/একে