Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘নীলকণ্ঠী’ ছাত্রলীগ ও ‘বিনিয়োগহীন’ কর্মীজীবন


২ ডিসেম্বর ২০১৯ ২০:৫২

ইতিহাসের ধারাবাহিক সংস্করণে ‘বিচ্যুতি ও আচ্ছন্নতা’ ‘বাম’ সংগঠনগুলোর পুরনো অভ্যাস। আহমদ ছফার ‘অলাত চক্র’ উপন্যাস তারই এক চুম্বক উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধকালীন ইন্দো-বাংলা সীমান্তে ‘শরণার্থী দুর্যোগ এবং প্রেম পুনঃপ্রেমের’ আখ্যান এই উপন্যাস। যেখানে ভারতে আশ্রিত এক ‘আওয়ামী লীগ’ প্রতিনিধির কাছে ‘বাম’ প্রতিনিধি প্রস্তাব করেন মুক্তিযুদ্ধে তাদের (বাম) সক্রিয় অংশগ্রহণের বিনিময়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে আক্রমণ সহযোগিতা দেওয়ার। যা তাদের ‘বিচ্যুতি, আচ্ছন্নতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী’ চিন্তার এক টুকরো প্রামাণ্য দলিল।

বিজ্ঞাপন

বৈদেশিক বিভ্রান্ত আচ্ছন্নতায় ডুবে থাকা ‘হাতুড়ি-কাস্তে’ খচিত লোগো সর্বস্ব এই সংগঠনগুলো আজও সেই টানেল থেকে বেরুতে পারেনি। যার সাক্ষ্য ‘বঙ্গবন্ধুর’ ‘দর্শন-চিন্তা’ বিমুখ এই সংগঠনগুলোর ‘বৈদেশিক আদর্শ আশ্রয় করে চলবার চেষ্টা এবং বোতলবন্দি বন্দনা’। সাংস্কৃতিক উপাদান ‘প্রবাদ-প্রবচন’ যেকোনো জাতিসত্ত্বার আত্মপরিচয় বা বোধকে প্রকাশ করে। সে হিসেবে মানুষের জীবনবোধ সৃষ্টিতে ‘আগে ঘর তবেই না পর’। অর্থাৎ ঘরের যে ‘জনক বা জাতির পিতা’ সেই তাঁকে না বুঝে, না মেনে, আত্মস্থ না করে, তারা ছুটে চলেন হাজার মাইল দূরের আদর্শ লালন-ধারণ এবং খিস্তি করতে !

বিজ্ঞাপন

অথচ বামদের বোধের আকাশে এটা খেলে না যে, যেকোনো ‘তত্ত্ব বা দর্শন’ ওই সময়ের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত হয়। সে হিসেবে এই বঙ্গের বা তল্লাটের একক আদর্শিক ‘তত্ত্ব বা দর্শন’ বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন। যাতে নিহিত বাংলার শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর এবং যেখান থেকে উত্তরণে একটি জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ই জীবন সংগ্রাম।

কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ মাত্রই বলবেন, ভিনদেশি দর্শন বা চিন্তাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা আর তৃষ্ণায় গ্লাসের বাহির দিয়ে জিহ্বা যোগে জল বা পানি স্পর্শের চেষ্টা প্রায় সমান। গ্লাসের বহিরাবরণ স্পর্শ আর যাই করুক তৃষ্ণা মেটাতে পারে না। বরং তা হতে পারে খানিক সময়ের সান্ত্বনা। তবে শঙ্কার বিষয় হলো ‘অজুহাত-ইস্যু’ভিত্তিক ‘জনবিচ্ছিন্ন’ এই বাম সংগঠনগুলোর কখনই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারার ক্ষমতা! আর এই এক অযোগ্যতাই প্রমাণ করেছে এদের অবস্থা ‘সালাদের’ মতো! অর্থাৎ, এদের কোনো নিজস্বতা নেই। এরা সালাদের মতই মুখরোচক; যা ভাত-পোলাও-খিচুড়ি সবকিছুর সাথেই যায়। কিছুদিন আগে ‘কোটা সংক্রান্ত’ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে পড়ার টেবিলে ফেরত যাওয়া শিক্ষার্থীদের বিএনপি-জামায়াত-শিবির-ছাত্রী সংস্থার নেতৃত্বে দেওয়া উস্কানিতে বামদের সমর্থন, সহযোগিতা এবং একই ঢঙে কথা বলাটা ছিল সেটারই বহিঃপ্রকাশ।

তাত্ত্বিক ‘ফ্রাঞ্জ ফানোর’ ‘জগতের ভাগ্যহত লাঞ্ছিত’ গ্রন্থে ‘স্বতঃস্ফূর্ততার চোরা ফাঁদ’ অংশে উল্লেখিত ‘অধিকার আদায়ে শুধু অংশগ্রহণে সফলতা আসে না বরং সেখানে দরকার যথার্থ সময় এবং সিদ্ধান্তের’। সে হিসেবে বলতে হয় বাংলার তরুণ প্রজন্ম সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে টেবিলে ফিরে গিয়েছিলেন। যদিও বামাতি-জামাতি, শিবির-ছাত্রী সংস্থার কর্মীদের সমন্বিত চেষ্টা ছিল দেশের তারুণ্যের সরল আবেগকে বিভ্রান্তের টানেলে নিয়ে ধ্বংসাত্মক পরিণতি টানা। আর পেছনে ছিল কিছু দেশি-বিদেশি পক্ষের ‘পক্ষপাত এবং ভিশনারি পরিকল্পনা’!

‘পক্ষপাত’ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আজাদ পঠিত বোধ মতে, যেকোনো চিন্তা বা দর্শন অর্জনে মানুষ কোনো না কোনো অংশে হেলে পড়বেই। এটাই মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কাজেই তারা যে এখন স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে চলমান রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপক্ষে হাল ধরেছিলেন সেটা আদতেই স্পষ্ট ছিল। আর ‘ভিশনারি’ প্রসঙ্গে শিবিররা একজন শিক্ষার্থীকে শতাধিক বই-গল্প-নিবন্ধ-প্রবন্ধ পড়ানোর মাধ্যমে যথাক্রমে সাথী, কর্মী এবং সদস্য হিসেবে রিক্রুট করেন। বই মানুষকে চিন্তাশীল এবং বহুমাত্রিক করে তোলে। আর সেখানে শিবির কর্মীরা এত এত বই সরবরাহ করছেন। কাজেই ছদ্মবেশী দেশপ্রেম এবং আদর্শের গাল-গল্পে শিশু-শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। আর এই অপপ্রক্রিয়াটি তারা চালানো শুরু করে স্কুল-কলেজ থেকেই।
শিশুর মন মাত্রই সরল; যেখানে যেকোনো চিন্তার বীজ সহজেই বোনা যায়। আর এই ভিশনারি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শিবিরদের কখনও কোন অর্থ সংকটও পরতে হয় না। অপ্রিয় সত্য হলো, রাজনীতিবিদদের মধ্যে একমাত্র তারাই কর্মীদের জন্য বিনিয়োগ করেন! আর সেটা কর্মীবাহিনী তৈরি থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র নির্মাণ পর্যন্ত। যার প্রমাণ সরকার-বিরোধীদল সব পক্ষেই শিবির-ছাত্রদলের ক্যাডারদের ‘নির্ভার ও নিশ্চিন্ত’ জীবনযাপন।

উল্টোদিকে ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক অগণিত ছাত্রলীগ কর্মীর কর্মচাঞ্চল্য দেখা গেলেও সাবেক কিংবা কর্মক্ষেত্রে এরা অনেকটাই নিরুদ্দেশ বনে যায়। আর এর কারণও বেশ নাটকীয়। বাঁক বদলের জীবনে একজন ছাত্রলীগ কর্মীর কর্মস্থল বহুক্ষেত্রেই হয়ে যায় ওই শয়তানের আখড়ায়। অর্থাৎ জামায়াত-শিবিরের প্রতিষ্ঠানগুলোয় তখন নিজের পরিবার-পরিজনের ‘মুখে ভাত’ নীতিতে বহুক্ষেত্রেই তারা বনে যান দর্শক। রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনাতেও তাদের চুপ থাকতে হয়। শুধুমাত্র একজন ছাত্রলীগ ‘কর্মী’ হওয়ায় কর্মক্ষেত্রে তাদের হতে হয় বঞ্চিত। প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষায়ও একের অধিকবার ভাইয়া দিয়েও জনগণকে সেবা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয় না। অথচ সরকারি ক্ষেত্র ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত নেতারা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন এবং সেখানে রিক্রুটমেন্টের বিশেষ যোগ্যতা তাদের কর্মী হওয়া।

তবে এই সত্য ও বাস্তবতা উপস্থাপন এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মুখরোচক সমালোচনা চলে আসে। এক্ষেত্রে মহামতি আহমদ ছফার এক উক্তিই যথেষ্ট- ‘বঙ্গবন্ধু যদি বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনতেন তাহলে এই দেশ কখনও স্বাধীন হত না।’ তাছাড়া তাত্ত্বিক ‘গ্রামসি’র বুদ্ধিজীবী সংক্রান্ত উপস্থাপনায় বুদ্ধিজীবী শ্রেণি দুই ধরণের। এক. প্রান্তিক বুদ্ধিজীবী- যারা নিজেরা খুন্নি বৃত্তি করে অর্থাৎ পরিশ্রমের বিনিময়র উপার্জন করেন। দুই. পালিত বুদ্ধিজীবী- যারা ভোগের বদলে অন্যের সমালোচনা এবং গুণকীর্তন করেন। আর রুঢ় বাস্তবতা হলো- আমাদের সমাজে এখন এই দ্বিতীয় শ্রেণির বুদ্ধিজীবীই বেশি।

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার এ প্রজন্মের তরুণদেরও সতর্ক থাকা জরুরি। কারণ কোটা সংস্কারের মত আরও অনেক ‘কৃত্রিম সংকট’ সৃষ্টি হতে পারে। যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে সহজেই সমাধানযোগ্য। কিন্তু সুযোগ সন্ধানীরা চাইবেনই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ‘আবেগ এবং উচ্ছ্বাস’কে উসকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে পেছনের দিকে টেনে ধরতে। আর এক্ষেত্রে তাদের টার্গেট হবে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। সম্প্রতি একটি মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এদের তৎপরতা আরও তুঙ্গে। যার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সেখানে নিষিদ্ধ হয়েছে ছাত্ররাজনীতি। শুধু তাই নয়, সরাসরি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো তৎপর হবার অপেক্ষায় জোঁকের মত ওঁৎ পেতে রয়েছে।
তবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ায় প্রতিক্রিয়াশীলরাই লাভজনক সবচেয়ে বেশি। কারণ সরাসরি আদর্শিক মোকাবিলা করার সাধ্যহীন এরা জানে লুকোচুরিতেই এদের জন্ম এবং এতেই এরা বংশ বিস্তারে পারদর্শী। যার প্রমাণ, নিষিদ্ধ এই সংগঠনগুলো বর্তমানে কাঠামো বৃদ্ধিতে সাংগঠনিক তৎপরতায় ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে।

প্রবাদ মতে- প্রকৃতি শূন্যস্থান রাখে না। সেটা ধূলা দিয়ে হলেও পূর্ণ করে দেয়। সরাসরি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের অর্থ দাঁড়ায় সেখানে কেউ না কেউ প্রবেশ করবেই। আর যেহেতু শিবিরের মত নিষিদ্ধ এবং মৌলবাদী সংগঠনের আচরণ সুযোগ অনুসন্ধান কাজেই সেখানে সরাসরি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের অর্থ তাদের সুযোগ করে দেওয়া। আর এক্ষেত্রে সুশীলরা যে আচরণ করেছেন এবং সামনেও করবেন সে বিষয় আমাদের জানাই রয়েছে।

কাজেই স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনা ‘নীলকণ্ঠী ছাত্রলীগ’কেই সতর্কতার সাথে দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। কারণ বঙ্গবন্ধুর চির যৌবন ভাবনার একমাত্র ছাত্রলীগেই বিশ্বাস বাংলাদেশের। তাঁরাই পারবেন সব ছদ্মবেশী ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের শয়তানদের রুখতে। আর এই আদর্শিক যুদ্ধ জয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দল-মত নির্বিশেষে সকলের পূর্ণ সমর্থন জোগাতে হবে।

লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।

ই-মেইল: [email protected]

কর্মীজীবন ছাত্রলীগ নীলকণ্ঠী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর