Saturday 07 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এই দীনতা ক্ষমা কর বীর


৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ২০:৪৬ | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ১১:২২
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আজকের এই দিনে দাঁড়িয়ে ভাবলে সাহসের মাত্রাটা ঠিক বোঝা যাবে না। কিন্তু ১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে ছেলেদের পাশে মেয়েরাও ১৪৪ ধারা ভেঙে পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিল; এটা বিস্ময়করই বটে। শুধু পুলিশ নয়; তাদের টপকাতে হয়েছিল সমাজ এবং পরিবারের বাধাও। সেই সাহসী নারীদের একজন রওশন আরা বাচ্চু। ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শুধু ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভাঙাই নয়, ভাষা আন্দোলন সংগঠনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি ইডেন কলেজ ও বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংগঠিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে নিয়ে এসেছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙতে গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জে আহতও হন রওশন আরা বাচ্চু।

বিজ্ঞাপন

এই বীর নারী যুগ যুগ ধরে আমাদের সাহসী করেছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন। এই বীর নারী চলে গেলেন বিজয়ের মাসে। ৩ ডিসেম্বর ভোররাতে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসাপাতালে মারা যান তিনি। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি সম্মিলিত অবহেলা আমাকে বিস্মিত করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে, লজ্জিত করেছে। তাঁর মৃত্যুর খবর জানাজানি হয়েছে অন্তত ১০ ঘণ্টা পর। এই লজ্জা আমাদের, এই ব্যর্থতা সবার। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে দ্রুত তাঁর শেষ শ্রদ্ধা ও জানাজার খবর নিতে গিয়ে আরও বিস্মিত হলাম! তেমন কোনো আয়োজনই নেই। পরিবারের উদ্যোগে বিকেলে বাংলা একাডেমিতে নেওয়া হলেও সেখানে তড়িঘড়ি করে ফুল দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো- এই ভাষা সৈনিকের মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়নি। বিশিষ্ট কেউ মারা গেলে তার মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তবে কার মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া হবে, কারটা নেওয়া হবে না; তার কোনো মাপকাঠি নেই। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধার বিষয়টি দেখভাল করে। এ নিয়ে অনেক রাজনীতিও হয়। কিন্তু যারা জীবনের পরোয়া না করে ভাষার জন্য পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিল, সেই ভাষা সৈনিকদের মরদেহই যদি শহীদ মিনারে নেওয়া হলো না। তাহলে আর কারও মরদেহই শহীদ মিনারে নেওয়ার দরকার নেই। শ্রদ্ধা জানাতে কেউ আসুক বা না আসুক, তবুও রওশন আরা বাচ্চুর মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া উচিত ছিল। তাতে অন্তত তাঁর আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পেত।

বিশিষ্ট কেউ মারা গেলে অনেকে শোক জানান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাহাকার ওঠে। কিন্তু রওশন আরা বাচ্চুর মত একজন ভাষা সৈনিকের মৃত্যুতে দেখছি আশ্চর্য নির্লিপ্ততা! রহস্যজনক নীরবতা! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ছাড়া আর কারও শোকবাণী চোখে পড়েনি। নারী সংগঠনগুলোও নিশ্চুপই ছিল। তাঁর পরিবার চেয়েছিল বাংলা একাডেমিতে জানাজা নামাজ হোক। কিন্তু একাডেমির অনাগ্রহে তাও হয়নি। সাংবাদিকদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থীর জানাজা হলেও তাতে উপস্থিত ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন। পরিচিত কাউকেই দেখা যায়নি। বেঁচে থাকতেও আমরা তাঁকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারিনি। রওশন আরা বাচ্চুর মতো ভাষাসৈনিকদের আন্দোলনে অর্জিত যে একুশ, সেই একুশে পদকও পাননি তিনি। মরণেও পেলেন না প্রাপ্য সম্মান।

আমি জানি না কেন এই নির্লিপ্ততা। তিনি কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন বলে আমরা জানা নেই। শেষ জীবনটা কাটিয়েছেন নিভৃতে। চলেও গেলেন অনেকটা নীরবেই। তিনি যদি কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত থাকতেনও, তাতে তো ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদান ম্লান হয়ে যায় না। একজন ভাষা সৈনিক বা মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ না বিএনপি করেন; তা দিয়ে নিশ্চযই তাঁর মর্যাদা নির্ণীত হবে না। হওয়া উচিত নয়।

কিছু পাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই রওশন আরা বাচ্চু ভাষা আন্দোলনে শামিল হননি। মৃত্যুর পর মর্যাদা পাবেন কিনা সেটা ভেবে নিশ্চয়ই তিনি ১৪৪ ধারা ভাঙতে যাননি। তাঁকে সম্মানিত করতে না পারা আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের লজ্জা, আমাদের নীচতা। এই দীনতা ক্ষমতা কর হে বীর।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

ভাষাসৈনিক মৃত্যু রওশন আরা বাচ্চু