কর্মসূচিহীনতায় ঐক্যফ্রন্টে ‘ফাটল’
৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ১০:০৭
ঢাকা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল নিয়ে গড়ে ওঠে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সেই নির্বাচনে বিশাল ভরাডুবির পর থেকেই সেই ঐক্যফ্রন্টের আওয়াজ স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে। একপর্যায়ে দৃশ্যমান কর্মসূচি থেকেই অদৃশ্য হয়ে যায় এই রাজনৈতিক জোট। বলতে গেলে মাঝে মাঝে জোটের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকেই টিকে আছে এই জোটের অস্তিত্ব।
এদিকে, নির্বাচন ঘিরে তৈরি হওয়া জোটটিকে নির্বাচনেই ইতি টানতে আগ্রহী কেউ কেউ। ফলে ঐক্যফ্রন্টের কোনো কোনো দল এরই মধ্যে জোটত্যাগের কথাও ভাবছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্বিক পরিস্থিতিতে ফাটল ধরেছে ঐক্যফ্রন্টের ঐক্যে। ক্রমেই অকার্যকর হওয়ার পথে হাঁটছে এই জোট।
একাধিক সূত্র বলছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জোটের পক্ষ থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার কথা বলেছিলেন জোটের শীর্ষ নেতারা। কিন্তু বাস্তবে কোনো দৃশ্যমান কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকতে পারেনি ঐক্যফ্রন্ট। ফলে জোটের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
এর আগে, গত ২ অক্টোবর ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে ফের সিদ্ধান্ত হয়, ঝিমিয়ে পড়া ঐক্যফ্রন্টকে জাগিয়ে তুলতে সরকারের পদত্যাগ ও নতুন করে নির্বাচনের দাবিতে দৃশ্যমান কর্মসূচি নিয়ে আসবে রাজনৈতিক জোটটি। অক্টোবর মাসেই সেই দৃশ্যমান কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার কথা ছিল তাদের। তবে ডিসেম্বর চলে এলেও সেই কর্মসূচির দেখা মেলেনি। এতে হতাশা তৈরি হয়েছে জোটের দলগুলোর মধ্যে। চূড়ান্ত পরিণতিতে জোটটি নিষ্ক্রিয় হওয়ার পথে।
ঐক্যফ্রন্টের একটি সূত্র বলছে, কিছুদিন আগে জোটের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন নিজেই জানিয়েছিলেন, নির্বাচন শেষে আর ঐক্য নেই। গণফোরামের এক আলোচনায় তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্ট ছিল নির্বাচনি ঐক্য। নির্বাচন শেষ হয়েছে। ঐক্যও শেষ হয়েছে। এখন বিএনপি যদি জামায়াতকে ছেড়ে আসতে পারে, তবেই তাদের সঙ্গে বড় ঐক্য হতে পারে।
ড. কামাল হোসেনের এমন বক্তব্য ঐক্যফ্রন্টের অকার্যকর হওয়ার পালে নতুন হাওয়া দেয়। জোটের সূত্র বলছে, এরপর জোটের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না তার নাগরিক ঐক্য নিয়ে জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের নেতৃত্বে গড়ে তোলা জাতীয় মুক্তিমঞ্চে যোগ দেওয়ার পথে রয়েছেন তিনি। শুধু নাগরিক ঐক্যই নয়, মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমের কল্যাণ পার্টিসহ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি দলও মুক্তিমঞ্চে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছে। এ অবস্থায় গণফোরাম আর আ স ম আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-ই (জাসদ) কেবল টিকে আছে ঐক্যফ্রন্টে।
রাজনৈতিক এই জোট নিয়ে আগ্রহ হারিয়েছে বিএনপিও। শুরুর দিকে ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা যোগ দিতেন। তবে বিএনপির কাছে জোটের গুরুত্ব কমতে থাকায় জোটের বৈঠকেও কমতে থাকে বিএনপির প্রতিনিধির র্যাংক। অবশ্য মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত জোটের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে বিএনপি পক্ষে উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার জামিন আদেশ এই বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ছিল বলেই মঈন খানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বিএনপির একটি সূত্র।
গত অক্টোবরের পর এটিই ছিল ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম বৈঠক। জোট সূত্র বলছে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল দেশের বাইরে থাকায় নভেম্বরে স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে তিনি দেশে ফেরার পরও বৈঠক আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। সেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে মঙ্গলবার। বৈঠকে খালেদা জিয়ার জামিন আদেশের পাশাপাশি ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে লিখিত সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়, খালেদা জিয়া জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন। জোট নেতা ড. কামাল বলেন, ‘এই মামলায় জামিন পাওয়ার সুযোগ অবশ্যই আছে।’ খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া না হলে তার জন্য যে পরিস্থিতি উদ্ভব হবে, সে বিষয়ে সরকারকে সতর্কও করে দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
তবে বৈঠকে ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বরের কর্মসূচি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি জোট নেতারা। ৫ ডিসেম্বরের পর ফের বৈঠক করে এ বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন। যদিও একাধিক সূত্র বলছে, এই দুই জাতীয় দিবসে জোটগতভাবে কোনো কর্মসূচি পালিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। দলগুলো আলাদা আলাদাভাবেই কর্মসূচি পালন করবে।
ঐক্যফ্রন্টের অকার্যকর হওয়ার পথে হাঁটতে থাকার বিষয়টি অবশ্য অস্বীকার করেছেন গণফোরাম নেতা ও জোটের অন্যতম সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট জগলুল আফ্রিদ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঐক্য অকার্যকর কোথায়? একটু অপেক্ষা করেন। ঐক্য কার্যকর দেখতে পাবেন।’ ঐক্য কিভাবে কার্যকর হবে— সে বিষয়ে অবশ্য বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি।
ঐক্যফ্রন্টের আরেক নেতা গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, দূরে থেকে দেখে অনেক কিছুই মনে হতে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।