জাকিয়া আহমেদ ও সোহেল রানা
ঢাকা : পোড়া শরীরের যন্ত্রণাটি একটু থিতু হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে ১১ বছরের কিশোরী মনি। এ সুযোগে রাজ্যের বিষণ্নতা আর ক্লান্তি নিয়ে মেয়ের বিছানার পাশে ঘাড় এলিয়ে দিয়ে কিছুটা ঝিমুনির চেষ্টা করেন কিশোরীর মা শিউলি বেগম। ২১ দিনের নির্ঘুম রাত্রির সমস্ত ক্লান্তি যেন চলিশোর্ধ্ব এই মায়ের চোখেমুখে। এমন অবস্থায় বার্ন ইউনিটের শিশু ওয়ার্ডে কথা হয় ‘স্বপ্নভঙ্গ হওয়া’ এ মায়ের সঙ্গে।
হয়ত কিছুটা বিরক্তিও জমে ছিল মায়ের মনে। তবে সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে আশ্বস্থ হলেন তিনি। কীভাবে পুড়েছে মেয়ের শরীর? জানতে চাইলে তিনি বলেন পেছনের যন্ত্রণা উদগীরণ করা গল্পগুলো। এরই ফাঁকে মেয়ের জন্য ওষুধ নিয়ে ফার্মেসি থেকে হাজির হন কিশোরীর বাবা মো. আজিজও। তিনিও যোগ দেন সারাবাংলার সঙ্গে দুঃখ-জরার গল্প বিনিময়ে।
শিউলির মুখের কথাগুলো কেড়ে নিয়ে এবার বলা শুরু করলেন আজিজ। আজিজ জানান, তিনি নরসিংদীতে রিকশা চালান। অভাব-অনটনে বয়ে বেড়ানো এক সংসার তার। শহরের পশ্চিম ব্রাহ্মন্দী এলাকায় ব্যাংক কর্মকর্তা হাসান সারোয়ার সোহেলের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন স্বামী-স্ত্রী ও তাদের একমাত্র মেয়ে মনি। অভাব-অনটনে মেয়েকে স্কুলে দিতে পারেননি। তবুও চেয়েছেন মেয়ে তার ভালো থাকুক, নিশ্চিন্তে থাকুক।
প্রত্যাশার পারদ আরও বাড়তে থাকে বাড়ির মালিক সোহেল ও গৃহকর্ত্রী মাহমুদা ইয়াসমিন নাজমার আশ্বাসে। একমাস আগে ওই দম্পতি তাদের শিশু সন্তানকে দেখভাল করার জন্য মনিকে বাসা থেকে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়, তাদের কাছে মনি যত্নেই থাকবে, আনন্দে থাকবে।
কিন্তু শিশু সন্তান দেখভালের পাশাপাশি ১১ বছরের মনিকে দিয়ে গৃহস্থালির সব কাজ করানো হতো বলে এবার অভিযোগ করেন মনির মা শিউলি বেগম। কেবল এখানেই শেষ নয়, গরম পানিতে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কোমল শিশুর শরীরের ১৬ শতাংশ।
মা শিউলি সারাাবংলাকে বলেন, ‘প্রায় এক মাস আগে নাজমা (গৃহকর্ত্রী) আইসা আমার মেয়েডারে নেয়। তখন কইছিল, আপনার মেয়ের কোনো কষ্ট হইব না, কষ্ট হলে সে দায় আমার। এ কথা বইলা আমার মাইয়ারে নিয়া আজ গরম পানি দিয়া পুড়াইল।’
বিলাপ করতে করতে শিউলি বেগম বলেন, ‘আমার কাছ থিইক্যা নিছে, নেওয়ার সময় কইছে, মাইয়ারে দিয়া কোনো কাজ করামু না, খালি হের বাচ্চাটারে রাখব। আমার হেই মাইয়ারে দিয়া ঘর মুছাইতো, যত কাপড় হইতো-সব ধোয়াইতো, মাছ-সবজি সব কুটাইতো। তবুও আমি ভাবছি, মাইয়াটা যদি খাইয়া পইরা ওইখানে ভালো থাকে, তাইলে থাকুক। কিন্তু মাইয়াটারে যে পোড়াইয়া দিব, সেই তো আমি ভাবি নাই, কোনো মানুষ যে এমন কইরা পুড়াইয়া দিতে পারে।’
কথা বলার ফাঁকে এবার যন্ত্রণামুখর ঘুম থেকে জেগে ওঠে মনি। সেও যোগ দেন তথ্য বিনিময়ে।
সেদিনের কথা উল্লেখ করে মনি বলে, ‘সকাল ৭টার দিকে ভাত আর ডাল বসাইছি, মাছ ভুনা করছি, শাক কাটছি। আগের রাতে জিরা, আদা, গরম মশলাসহ অনেক মশলা বাটছি, হাত দুইটা ব্যথা ছিল খুব। পানির পাতিল যেইটা চুলায় ছিল সেইটা অনেক বড়, ভরা পাতিল, আমি উঠাইয়া নিতে পারতাম না। আন্টি সেই পাতিলটা আমারে বাথরুমে নিয়া যাইতে কইল।’
‘আমি কইলাম, এত বড় পাতিল তো আমি নিতে পারতাম না আন্টি, আমি নিতে পারুম না, কথা শেষও হয় নাই। পাতিল থেকে মগে পানি নিয়া আমার দিকে ছুইড়া মারল।’
‘গরম পানি আমার দুই হাতে লাগছে, মুখে লাগছে। যন্ত্রণায় চিৎকার দিছি। আশেপাশের কয়েকজন লোক এসে আমারে হাসপাতালে নিছে।’
মনির বাবা আজিজ বলেন, ‘মেয়ের শরীরের ১৬ ভাগ পুড়ে গেছে। দুই হাত পুড়ছে, মুখের একপাশ পুড়েছে। খবর পেয়ে নরসিংদী হাসপাতালে গিয়ে মেয়েকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় নিয়ে আসছি।’
‘কয়দিন পর দেখি মেয়ের অবস্থা কাহিল। কিন্তু ডাক্তার দেখাইতে পারি নাই। আমরা যাতে মেয়েরে ডাক্তারের কাছে নিতে না পারি পাহারা দেওয়ার জন্য লোক ঠিক করে রেখেছিল।
অভিযোগ করে শিউলি বলেন, ‘বহুত কইছি, কিছু করতাম না, খালি মাইয়াডারে চিকিৎসা করামু, তাও আসতে দেয় নাই। পরে একদিন রাত দেড়টার দিকে পলাইয়া আমরা হাসপাতালে আসার জন্য বাইর হই, পরের দিন সকালে এহানে মাইয়ারে ভর্তি করাই।’
‘এত বড় কাজ কইরা তারা আমারে জানায়ও নাই। রাইতের বেলায় বাড়ির সামনে মাইয়াডারে একটা মলমের কোটাসহ ফালাইয়া রাইখা গেছে।’
‘তিনদিন পর ফোন দিয়া তাদেরকে আসতে কইলে হেরা উত্তর দিলো, অফিস রাইখা আসতে পারব না’ বলেন শিউলি।
এর আগেও তার মেয়েকে মারধর করা হয়েছে জানান শিউলি।
এর আগে মারধর করা হয়েছে, তাহলে আবার কেন সেই বাসায় দিলেন জানতে চাইলে শিউলি বেগম বলেন, নিয়া আসতে চাইছি। কিন্তু কেবল হাতে পায়ে ধরা হেরা বাকি রাখছে। কইছে, আর এমন করব না। কিন্তু তারা কথা রাখে নাই। মাইয়াডারে হাসপাতালে পাঠাইছে এবার।
মনির হাসপাতালে ভর্তির কাগজপত্র দেখে জানা যায়, গত ২৪ জানুয়ারি বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছে মনি।
মেয়েকে দগ্ধ করার ঘটনায় আইনি প্রতিকার চেয়ে নরসিংদী থানায় অভিযোগও দিয়েছেন মনির বাবা আজিজ। আসামিরা নরসিংদীতে থাকলেও তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এ বিষয়ে একটি মামলা হয়েছে, আসামিদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করছি।’
আসামিরা নরসিংদীতেই রয়েছে এমন সংবাদ আমরা জানতে পেরেছি বলে জানালে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আপনারা অনেক কিছুই জানতে পারেন, কিন্তু আমরা তাদের এখনও গ্রেফতার করতে পারিনি এটাই সত্যি। তবে চেষ্টা চলছে।’
এদিকে একাধিকবার অভিযুক্ত হাসান সারোয়ার সোহেলের ফোন নম্বরে কল করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সারাবাংলা/জেএ/একে