নির্বাচনি জোট: ২টি সক্রিয়, নিষ্ক্রিয় ৪টি
৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৬:২০
ঢাকা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মোট ছয়টি নতুন নির্বাচনি জোট গড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে তিনটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে, দুইটি নিজেদের মতো করে এবং একটি বিএনপির সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচনের অংশ নেয়। তবে ভোটের বছর না পেরুতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে জোটের রাজনীতি। নির্বাচনের সামনে রেখে গড়ে ওঠা ছয়টি জোটের মধ্যে এখন দুইটি মোটামুট সক্রিয়। বাকি চারটি একেবারেই নিষ্ক্রিয়।
নির্বাচন ঘিরে গড়ে ওঠা জোটগুলো হলো— ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর (বি. চৌধুরী) নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট, সিপিবি-বাসদ নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ), মিছবাহুর রহমান চৌধুরী নেতৃত্বাধীন ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স এবং আওয়ামী লীগ-জাপা নেতৃত্বাধীন মহাজোট। এর মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বাম গণতান্ত্রিক জোট ছাড়া বাকি কোনো জোটেরই দৃশ্যমান কার্যক্রম নেই।
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বাইরে তেমন কোনো দল বা জোট অংশ নেয়নি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১৪ দল ছাড়া প্রায় সবার প্রধান দাবি ছিল ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করা।
কিন্তু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন আয়োজনে অনড় থাকে। এমন পরিস্থিতিতে নিবন্ধন ও দলীয় অস্তিত্ব রক্ষায় বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভোটের আগে সমমনাদের নিয়ে গড়ে তোলে ‘নির্বাচনি’ জোট।
কিন্তু এই মুহূর্তে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ ও সিপিবি-বাসদ নেতৃত্বাধীন ‘বাম গণতান্ত্রিক’ জোট ছাড়া অন্যগুলোর দৃশ্যমান কোনো কর্মকাণ্ড নেই। বিশ্লেষকদের মতে, প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাছ থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় নির্বাচনের আগে ছোট ছোট রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো নিত্যনতুন জোট গড়ে ওঠার রেওয়াজ যেমন পুরোনো, তেমনি ভোটের পর জোটগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার ঘটনাও নতুন নয়।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাত্র দেড় মাস আগে ১৩ অক্টোবর ঘটা করেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মেনে নিয়েই রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এই জোটে যোগ দেয়।
বঙ্গবন্ধুর ‘চার খলিফা’র অন্যতম আ স ম আবদুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা বঙ্গবীবর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য নিয়ে গঠিত ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। চরম সংকটে থাকা বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে আশার আলো দেখতে পায়।
কিন্তু নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবি, জোটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খানের শপথ গ্রহণের ফলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ফাটল দেখা দেয়। এই ঘটনার জেরে বঙ্গবীর জোট থেকে বেরিয়ে যান। বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জোটে আসা বন্ধ করে দেন। জোটের স্থায়ীত্ব নিয়ে দেখা দেয় সংশয়।
তবে শেষ পর্যন্ত জোটের ভাঙন চূড়ান্ত রূপ নেয়নি। জোটের প্রধান চার শরিক দলের নেতারা নিয়মিত বৈঠক করছেন। এ জোটের সর্বশেস বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর)। সেখানে গণফোরাম, বিএনপি, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
জোটের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘জোট সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক মেসেজ পাবলিককে দিয়েন না। আজও (মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর) আমরা মিটিং করেছি। ৫ ডিসেম্বরের পর আবার করব। জোট সক্রিয় আছে, থাকবে।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে আ স ম আবদুর রব সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম দিন জোট যেমন ছিল, এখনো তেমন আছে। জোট আছে, জোট থাকবে।’
বাম গণতান্ত্রিক জোট
নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সমন্বয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোট গঠিত হয়।
ভোটের আগে গড়া নির্বাচনি জোট ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ ভোটের পরও সমানতালে সক্রিয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি, দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অনিয়মসহ নানা ইস্যুতে এই জোট তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে রাজপথে সক্রিয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই জোটই প্রথম হরতাল আহ্বান করে। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গত ৭ জুলাই সারাদেশে আধাবেলা হরতাল পালন করে তারা। তাদের ওই কর্মসূচিতে বিএনপিসহ ক্ষমতার বাইরে থাকা বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নৈতিক সমর্থন দেয়। এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেধে নির্বাচন করা যুক্তফ্রন্টের দুইটি শরিকদল ‘বাংলাদেশ ন্যাপ’ ও এনডিপি’র শীর্ষ নেতারা হরতালের পক্ষে রাজপথে পিকেটিং করেন।
যুক্তফ্রন্ট
গত বছর ১৩ অক্টোবর ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগেই বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বি. চৌধুরী) নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। সেখানে আ স ম আবদুর রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ও মাহমুদুর রহমান মান্নাও ছিলেন।
ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর আ স ম আবদুর রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না বেরিয়ে আসেন যুক্তফ্রন্ট থেকে। পরে বিএনপি জোট ছেড়ে আসা জেবেল রহমান গানির বাংলাদেশ ন্যাপ, খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার এনডিপি, নাজিম উদ্দিন আল আজাদের বিএলডিপি, শেখ আসাদুজ্জামানের জাতীয় জনতা পার্টি, অধ্যক্ষ মতিনের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, সর্দার শামস আল মামুনের গণসাংস্কৃতিক দল, ওসমান গণি বেলালের বাংলাদেশ জনতা লীগ, মাসুম বিল্লাহ’র বাংলাদেশ শরিয়া আন্দোলন ও হামদুল্লাহ আল মেহেদীর বাংলাদেশ লেবার পার্টিকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট সম্প্রসারিত করেন বি. চৌধুরী। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেয় যুক্তফ্রন্ট।
কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছ থেকে নির্বাচনি আসন আদায়ের ক্ষেত্রে ছেলে মাহী বি. চৌধুরী ও বিয়াই মেজর (অব.) মান্নান ছাড়া জোটের আর কারও ব্যাপারে খুব একটা সিরিয়াস ছিলেন না বি. চৌধুরী— এমনটিই অভিযোগ যুক্তফ্রন্ট শরিকদের। ফলে নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্টের শরিকরা নিষ্ক্রিয় হতে থাকেন। এখন যুক্তফ্রন্টের কোনো কর্মকাণ্ড, মিটিং-সিটিং হয় না। জোটের শরিক দলগুলো চলছে যে যার মতো।
জানতে চাইলে যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত তিন/চার মাস যুক্তফ্রন্টের কোনো বৈঠক হয়নি। সুতরাং যুক্তফ্রন্টের কোনো অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না।’
বিএনএ
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে যতবার ভোট করেছেন, তার চেয়ে বেশি জোট গড়েছেন— ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সম্পর্কে এমন একটা কথা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে চালু রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও তিনি জোট গড়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ)।
তৃণমূল বিএনপি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সম্মিলিত ইসলামিক জোট, একামত আন্দোলন, কৃষক শ্রমিক পার্টি, জাগো দল, গণতান্ত্রিক জোট ও ইসলামিক ফ্রন্ট নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় জোট গঠন করে বিএনপির সাবেক নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচনের ইচ্ছা পোষণ করেন।
কিন্তু আওয়ামী লীগ তাকে নৌকার টিকেট দেয়নি। উপায়ন্ত না দেখে ঢাকা-১৭ আসনে স্বতন্ত্র প্রতীকে নির্বাচন করেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। নির্বাচনের পর বিএনএ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স
নির্বাচনের আগে মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, নুরুল ইসলাম খানের গণতান্ত্রিক ইসলামিক মুভমেন্ট, এম এ রশিদ প্রধানের বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, হাসরত খান ভাষানীর বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ, রুমা আলীর বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, মাওলানা শাহ মোস্তাকিম বিল্লাহ ছিদ্দিকীর বাংলাদেশ জমিয়তে দারুসসুন্নাহ, মাওলানা হারিছুল হকের বাংলাদেশ ইসলামী ডেমোক্রেটিক ফোরাম, হাকিম গোলাম মোস্তফার বাংলাদেশ গণকাফেলা, মুফতি ফখরুল ইসলামের বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলন, কাজী মাসুদ আহমদের বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি, রেজাউল করিম চৌধুরীর বাংলাদেশ ইসলামী পেশাজীবী পরিষদ, মুফতি সৈয়দ মাহাদী হাসান বুলবুলের ইসলামী ইউনিয়ন বাংলাদেশ, খাজা মহিবুল্লাহ শান্তিপুরীর বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলন ও আব্দুল্লাহ জিয়ার ন্যাশনাল লেবার পার্টির সমন্বয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স গঠন করা হয়। ভোটের পর নির্বাচনি জোট সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
মহাজোট
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি (জাপা) সমন্বয়ে গড়া ‘মহাজোট’ এক নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে— এমনটিই মূল্যায়ন রাজনীতি বিশ্লেষকদের। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সঙ্গে জাতীয় পার্টি যুক্ত হয়ে টানা তিনটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে মহাজোট। নির্বাচনের পর ১৪ দল অক্ষত থাকলেও জাতীয় পার্টি বেরিয়ে যাওয়ায় সেই জোটের অস্তিত্ব আপনা-আপনি বিলীন হয়ে গেছে। সর্বশেষ দু’টি নির্বাচনে মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে, আর জাপা হয়েছে প্রধান বিরোধী দল। এবং যথারীতি ভোটের পর জোটের অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে।