Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাহাড় এসেছে রাজধানীতে!


৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১১:৫১

নানা কাঠ, খড় পুড়িয়ে অনেকেই এখন খোঁজেন অর্গানিক ফুডসহ নানা পণ্য। কেউ কেউ তো এখন সরাসরি গ্রামে চলে যান ভেজালমুক্ত জিনিস কিনতে। সেই হিসেবে পাহাড়ের নানারকম পণ্যেও মানুষের ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সবসময়তো আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। তাই পাহাড়ই কয়েকদিনের জন্য চলে এসেছে রাজধানীতে।

হ্যাঁ রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় উৎপাদিত সবজি, শস্য, ফলমূল, বস্ত্র, পাট, বাঁশ ও বেতের তৈরি নানা গৃহস্থালি পণের‌্য মেলা। অনেকেই অর্গানিক পণ্যের আশায় ছুটছেন এখানেই। মেলায় আছে, পাহাড়ি, সবজি, খাবার, ফলমূল, ঘর সাজানোর নানা পণ্য, কাপড়চোপড়, কলা, কমলালেবু, কুমড়ো, বেগুন, পেঁপে, আনারস, বাতাবি লেবু, কচু, হলুদ, আদা, মরিচ, শুটকিসহ অনেক পণ্য।

কৃষিপণ্যে ভেজাল, নিম্নমানের প্ল্যাস্টিক পণ্য আর বিদেশি কাপড়ে যখন বাজার সয়লাব, তখন চাহিদা বাড়ছে পাহাড়ি পণ্যের। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীর প্রচার ও বিপণনের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে এই মেলা আয়োজিত হয়ে আসছে গত পাঁচ বছর ধরে। এবারের মেলায় তিন পার্বত্য জেলা থেকে আসা উদ্যোক্তাদের প্রায় ১০০ টি স্টল রয়েছে। এসব স্টলে মিলছে পাহাড়ি পোশাক, জুমের উৎপাদিত কৃষি পণ্য, ফল-ফলাদি ও পাহাড়ি বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী। এছাড়াও মেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন দফতর ও সংস্থাসমূহের স্টল স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। এখানে থাকছে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার শিল্পীদের পরিবেশনা।

ক্রেতাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পাহাড়ি কৃষিপণ্য প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত হয়, সুস্বাদু, সার বা কীটনাশকের ব্যবহার কম তাই তারা এগুলো কিনছেন।

একটি স্টলে দেখা গেল জুম চাষের নানা পণ্য সামগ্রী। স্টলে ছিলেন, রাঙামাটি সদর উপজেলার উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তা রাজিব রায় চৌধুরী। তিনি বলেন, রাঙামাটির বিভিন্ন পাহাড়ে কীটনাশক বিহীন উৎপাদিত কৃষিপণ্য রয়েছে। কয়েকরকম বিন্নি ধানের চাল, ফলমূল ও মশলাসহ নানা কৃষিজ পণ্য রয়েছে এখানে। তিনি বললেন, এসব পণ্যের প্রচুর চাহিদা দেখতে পাচ্ছেন, বিক্রিও ভালো হচ্ছে। সারা বছর এসব ঢাকায় পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেরকম স্থায়ী ব্যবস্থা নাই। তবে অনেকেই তাদের ফোন নাম্বার নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের উদ্যোগে পরে আনার জন্য।

রাঙামাটির চম্বকনগর থেকে বেতের তৈরি ব্যাগ নিয়ে এসেছেন কৃষ্ণচন্দ্র চাকমা। নিজের হাতেই ব্যাগগুলো বানান তিনি। সাহায্য করে পরিবারের সদস্যরাও। রাঙামাটিতে নিজস্ব দোকান আছে তাদের। সেখানে ভালোই বিক্রি হলেও, মেলায় তার ব্যাগ তেমন একটা বিক্রি হচ্ছে না দেখে কিছুটা হতাশ তিনি। তিনি মনে করেন, পাহাড়ি পণ্যের প্রচারণা কম থাকায় মানুষ হাতে তৈরি এসব পণ্য সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না। আরও প্রচারণা হলে বিক্রি আরও বাড়তো বলে মনে করেন তিনি। মেলায় তার মেয়ের প্রতিষ্ঠান রাঙামাটি বুটিকসেরও স্টল রয়েছে যেখানে মিলছে স্থানীয় পোশাকসহ নানা কিছু।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মেজবাহুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক পার্বত্য দিবসকে সামনে রেখে পাঁচ বছর ধরে এই মেলার উদযাপন করছেন তারা। পাশাপাশি বিজয়ের মাসে বিজয়ের মূল চেতনা ও সাফল্যের সঙ্গে পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২২ বছর উদযাপন এই মেলাকে বিশেষত্ব দিয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, পাহাড়ের কৃষি, নানারকম পণ্য, সংস্কৃতি, ট্যুরিজমসহ নানা বিষয়ের প্রচারণাই তাদের উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে পাহাড়ের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সঙ্গে একটা সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়তেও সাহায্য করছে এই মেলা।

পাহাড়ের নিরাপদ কৃষিপণ্যের ব্যাপারে যে বিপুল সাড়া তারা পাচ্ছেন সেক্ষেত্রে এসব পণ্য সারাবছর ঢাকায় পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা বা উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরইমধ্যে পাহাড় থেকে প্রচুর পণ্য আসে কিন্তু সেগুলো আলাদা করে পাহাড়ের পণ্য হিসেবে বিক্রি হয় না সাধারণ বাজারে। কেউ যদি পাহাড়ি পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিতে চান, সেক্ষেত্রে তাদের মন্ত্রণালয় থেকে সাহায্য করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। এরইমধ্যে তারা কিছু উদ্যোগ নিচ্ছেন, কিন্তু কেউ আরও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে চাইলে প্রাথমিকভাবে সাহায্য করবে এই মন্ত্রণালয়।

মেলায় দেখা গেল মুনালি কমিউনিটি ট্যুরিজমের স্টল। কথা হল এই ট্যুরিজমের কো-অর্ডিনেটর আর্কিটেক্ট শাহরিয়াজের সঙ্গে। কমিউনিটি ট্যুরিজম বিষয়ে বললেন, এটি একটি টেকসই আর সমন্বিত পর্যটন পরিকল্পনা। পর্যটন করপোরেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় বান্দরবানের রুমা উপজেলার মুনলাই পাড়ায় তারা একটি প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছেন। বগা লেক যাওয়ার পথে রুমা বাজার থেকে চার কিলোমিটার দূরে একটি বম পাড়ায় তারা কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এই পাড়ার অধিবাসীদের জীবনযাত্রার সঙ্গে পর্যটকদের একটা সম্পর্ক তৈরিই তাদের উদ্দেশ্য বলে জানালেন তিনি। পর্যটকরা এখানে স্থানীয় বম অধিবাসীদের বাড়িতে থাকার ও তাদের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। সেখানে স্থানীয় খাবার খাওয়ার, তাঁতপণ্য কেনার ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছেন। রয়েছে সাঙ্গু নদীতে কায়াকিংয়ের সুযোগ। বেস ক্যাম্প বাংলাদেশের মাধ্যমে পর্যটকরা এই অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পাবেন।

মেলায় একটি স্টলে প্রদর্শিত হচ্ছে বান্দরবানে উৎপাদিত কফি ও কাজু বাদাম। কথা হল কফি উৎপাদক জেমস হিলটন বমের সঙ্গে। তিনি এসেছেন বান্দরবনের রুমায় দার্জিলিং পাড়া থেকে। জেমসের কাছ থেকে জানা গেল, কফি চাষ হয় রুমায় আর কাজু বাদাম চাষ হয় থানচিতে। তিনি বললেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পারিবারিকভাবে কফি উৎপাদন করে আসছেন তারা। প্রাচীন আমল থেকেই তারা পাকা কফি ফল শুকিয়ে ভেঁজে কফি বীজ ঢেঁকিতে গুঁড়ো করে ফুটন্ত পানিতে জ্বাল দিয়ে কফি পান করে আসছেন। কফি যে একটি অর্থনৈতিক ফসল এ সম্পর্কে তাদের ধারণাও ছিল না। এমনকি কফির পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে চায়ের মত পান করেন তারা।

এখন বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসঙ্ঘের খাদ্য বিষয়ক সংস্থা ফাওয়ের মাধ্যমে তারা কফির উৎপাদন ও প্রোসেসিং সম্পর্কে ট্রেনিং নিয়েছেন ও বাজারজাত করছেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে উৎপাদিত এই কফি পাওয়া যাচ্ছে নর্থ এন্ড কফি শপে। কাজু বাদাম সম্পর্কে জেমস বললেন, এই বাদাম আদি কাল থেকে তারা আগুনে পুড়িয়ে খেয়ে আসছেন। পোড়া খোসা ফেলে দিয়ে ভেতরের শাঁসটা খেতেন তারা। এখন কৃষি বিভাগের উদ্যোগে তারা দেশে উৎপাদিত কাজুবাদাম বিক্রি করছেন। এখানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কফি ও কাজু বাদামের ব্যাপারে মানুষ প্রচুর আগ্রহ দেখাচ্ছেন বলে জানালেন তিনি।

মেলায় দেখা মিললো কার্পাস তুলা গাছ, সুতা, ও তাঁতবস্ত্রের একটি স্টল। এখানে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের ঢাকা জোনের একজন কর্মচারির সঙ্গে কথা হল। তিনি বলেন, এই দোকানে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার বিভিন্ন পাহাড়ে উৎপাদিত তুলা প্রদর্শন করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মিলছে স্থানীয়দের তাঁতে তৈরি নানা সামগ্রী। চাদর, মাফলার, গামছা, লুঙ্গি, থ্রি, পিস থামি ইত্যাদির পুরোটাই হাতে তৈরি হয় বলে জানালেন তিনি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কার্পাস তুলা হাতে চালিত মেশিনের মাধ্যমে সুতা কাটা হয়। এবং পরে সেই তুলা দিয়ে তাঁতে কাপড় বোনা হয়।

এছাড়াও মেলায় রয়েছে পাহাড়ি অধিবাসীদের খাবারের নানা দোকান। নানারকম পিঠা, পাচন, কাঁকড়া, শুটকিসহ মিলছে নানারকম খাবার। কাঁচা কৃষিদ্রব্য ছাড়াও ভিড় চোখে পড়ছে সেসব খাবারের দোকানেও।


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর