Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধর্ষণ, হত্যা নাকি আত্মহত্যা? রুম্পার মৃত্যু রহস্য জানতে বিক্ষোভ


৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৬:৫৯

ঢাকা: স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এ অভিযোগে রুম্পার সহপাঠীরা দ্বিতীয় দিনের মতো ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন। এসময় তারা রুম্পার মৃত্যু হত্যা বা আত্মহত্যা যাইহোক, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তার রহস্য বের করে আনতে পুলিশ প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (৭ ডিসেম্বর) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ শেষে তারা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা বক্তব্য দেন।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আরিফুর রহমান বলেন, রুম্পা আত্মহত্যা করার মত মেয়ে না। তাকে যতটুকু জানি, সে সংস্কৃতি মনা, সারাক্ষণ সবার সাথে কথা বলে মাতিয়ে রাখত। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করা, পিকনিক আয়োজন করাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান কাজে সহযোগিতা করত সে। যে কারণেই হোক রুম্পা আর পৃথিবীতে নেই। তার মৃত্যু হয়েছে এটাই সত্য। এখন তার মৃত্যুর রহস্য বের করা দরকার। সবাই জানতে চায়, কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ যেন সেই কাজটিই করে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

অধ্যাপক আরিফুর রহমানের মত শিক্ষার্থীদেরও একই দাবি, রুম্পা আত্মহত্যা করতে পারে না। কারণ আত্মহত্যা করার পেছনে যেসব কারণ থাকে, তার কোনোটাই রুম্পার মধ্যে কোনো দিন কেউ দেখেননি।

ইংরেজী বিভাগের ৫১ ব্যাচের শিক্ষার্থী জান্নাত সারাবাংলাকে বলেন, ধর্ষণ, হত্যা কিংবা আত্মহত্যা যাই হোক তদন্ত সাপেক্ষে রহস্য বের হোক। এরকম মৃত্যু আর কাম্য নয়। আজ তিন দিন হয়ে গেলো। ঘটনার কোনো রহস্য বের হলো না। এভাবে আরেকটি ইস্যু আসবে, রুম্পার মৃত্যুর তদন্ত অজানাই থেকে যাবে, তা যেন না হয়।

৬৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী আখি বলেন, মাঝরাতে এত দুরে অন্য একটি ভবনের ছাদে রুম্পা কেন যাবে? সেটাই তো রহস্যময়। নিজে মরার জন্য নিজের কেন আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সের ছাদ বেছে নেবেন। রুম্পার বাসারও তো ছাদ রয়েছে। কাজেই পুরো ব্যাপারটি একেবারই রহস্যময় মনে হচ্ছে। এছাড়া তাকে যখন উদ্ধার করা হয়, তার শরীর ছিল ঠাণ্ডা। মনে হয় আগেই তাকে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া একজন লাফিয়ে পড়লে তার তো রক্ত বের হবে। রুম্পার কোনো রক্ত বের হয়নি। শুধু নাকের কাছে সামান্য রক্ত ছিল।

বিজ্ঞাপন

আর ৫৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী রাশেদ বলেন, রুম্পার গ্রামের বাড়ি এলাকায় আমার বাড়ি। সেই সুবাদে ক্যাম্পাসে একে অপরকে দেশি বলে ডাকতাম। ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৬টায় রুম্পার সঙ্গে ক্যাম্পাসে দেখা হয়। সে কফি খাওয়ায়। সামনে পিকনিক আসছে সেটা নিয়ে আলোচনা হয়। ব্যাডমিন্টন  নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর সে টিউশনির কথা বলে চলে যায়।

রুম্পার মরদেহ উদ্ধার করা স্থানটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে মরদেহটি পড়েছিল তার ডান দিকে একটি চারতলা ভবন। বায়ে আরেকটি পাঁচতলা ভবন। দুই ভবনের পেছনে ১১ তলা ভবনটি আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স। সংশ্লিষ্টদের ধারণা ১১ তলা ভবনের ছাদ থেকেই রুম্পা লাফ দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে সেখানে থাকা জাকির হোসেন নামে একজন সারাবাংলাকে বলেন, চারতলা ও পাঁচতলা ভবনটির ছাদে টিনশেট রয়েছে। তাছাড়া ছাদে উঠতে গেলেও কেউ না কেউ জানত।

অন্যদিকে ১১ তলা ভবনটিতে উঠতে কারও বাধা নেই। ভবনটির  চার তলায় বিভিন্ন কোম্পানির করপোরেট অফিস। পাঁচতলায় মালিক পক্ষ থাকেন আর ষষ্ঠ তলা থেকে ১১ তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন। লিফট দিয়ে উঠলে ১০ তলা পর্ন্ত উঠে সিড়ি বেয়ে ১১ তলার ছাদে উঠতে হয়। ভবনটির ছাদে কবুতর পালন করা হয়।

চারতলা ভবনের নীচতলা ও চতুর্থতলায় ব্যাচেলরদের জন্য মেস রয়েছে। পাঁচতলা ভবনটির চতুর্থ তলাতেও একটি মেয়েদের মেস রয়েছে। তবে নীচতলার মেসটিতে কাউকে পাওয়া যায়নি। সব কক্ষেই তালা লাগানো পাওয়া গেছে।

রুম্পার মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে রমনা মডেল থানা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশও মাঠে নেমেছে। এরই মধ্যে ভবনে থাকা সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে।

রুম্পার চাচা নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, দুই ভাইবোনের মধ্যে রুম্পা ছিল বড়। তাদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের বিজয় নগরে। রুম্পা শাহজাহানপুরের শান্তিবাগের একটি ফ্ল্যাটে মা-ভাইয়ের সঙ্গে থাকত। বাসা থেকে ৪-৫ মিনিট দূরত্বের একটি ফ্ল্যাটে চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে পড়াত।  সেদিনও সে টিউশ্যুনিতে যায়। এক ঘণ্টা পড়ানোর পর বের হয়ে বাসার নিচে গিয়ে রুম্পা তার মাকে ফোনে চাচাতো ভাইকে দিয়ে বাসার নিচে তার একজোড়া স্যান্ডেল পাঠাতে বলে। পরে ১০ বছরের চাচাতো ভাই একজোড়া স্যান্ডেল নিয়ে নিচে নামলে সে তা পায়ে দেয়। এরপর তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, আংটি, হাতঘড়ি ও ব্যাগ চাচাতো ভাইয়ের কাছে দেয়। তাকে বলে, আম্মুকে বলিস আপু একটু পরে বাসায় ফিরবে।

কিন্তু মোবাইল ফোন, আংটি, হাতঘড়ি ও ব্যাগ বাসায় পাঠোনোর উদ্দেশ্য কী ছিল তা বলতে পারব বলে বলেও জানান রুম্পার চাচা। বলেন, সেদিন  রাতে সে বাসায় না ফেরায় খোঁজাখুঁজি করি সবাই। পরদিন মর্গে গিয়ে রুম্পার মরদেহ শনাক্ত করি।

রমনা জোনের একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, রুম্পা সেদিন কেন তার ব্যবহৃত সকল জিনিসপত্র বাসায় রেখে বের হলেন। ওই অবস্থায় কেন অন্য আরেকটি ভবনে গিয়ে লাফ দিলেন তা ভাবনায় ফেলেছে পুলিশকে। মোবাইল ফোনটাও সাথে রাখেননি রুম্পা। বিষয়টি রহস্যজনক। ওই ভবনে কি এর আগেও গিয়েছিল রুম্পা তাও জানা যাচ্ছে না। আত্মহত্যা করার জন্য ওই ভবন বেছে নেওয়ার কারণ কি? সবকিছু ভাবনায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। আশা করছি, খুব শিগগিরই একটা কিছু বের হবে তদন্তে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সারাবাংলাকে বলেন, ১১ তলা ভবনের ছাদে কিনার (কবুতরের খাচার পেছনে ও মরদেহ পাওয়ার স্থানের ঠিক ওপরে) থেকে দুটি পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। ধুলা জমে থাকা এবং কেউ না যাওয়ায় একজনের পায়ের দাগ স্পষ্ট রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পায়ের ছাপ দুটি রুম্পার। নির্জন ওই ছাদে রুম্পা কেন গেলো তা নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আবার কেউ তাকে হত্যা করার পর সেখান থেকে ফেলে দিয়েছে কিনা সেটাও তদন্ত করা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। গোয়েন্দাদের ধারণা, হয় ওই ভবনগুলোর কারও সাথে রুম্পার পুর্ব পরিচয় রয়েছে, নতুবা ঘটনার দিন কারও সাথে রুম্পা সেখানে গিয়েছে। ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেলেও পূর্ণ নিশ্চিত করতে পারেনি ফরেনসিক চিকিৎসক।

বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রুম্পার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, লাশের শরীরের আঘাত দেখে মনে হয়েছে, ওপর থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কি-না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে। প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।

রমনা থানা পুলিশ জানায়, বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাত সোয়া ১০টার দিকে সিদ্ধেশ্বরীর সার্কুলার রোডের ৬৪/৪ নম্বর বাড়ির সামনে থেকে রুম্পার লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায় পুলিশ। পরিচয় না পাওয়ায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে রমনা থানায় মামলা করে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রুম্পার স্বজনরা মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করলে জানা যায়, রুম্পা স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তার বাবা রোকন উদ্দিন পুলিশের পরিদর্শক হিসেবে হবিগঞ্জে কর্মরত আছেন। রাজধানীর শান্তিবাগে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে থাকত রুম্পা।

আত্মহত্যা ধর্ষণ রুম্পা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর