নতুন সড়ক আইন— আসল গলদটা যেখানে!
৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৮:৫৩
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১২ বছর আগে যে আইনটির যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল সেটি অনেক জল ঘোলা করে গত ১ নভেম্বর কার্যকর হয়েছে। এর আগে ১৯৮৩ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল মোটরযান আইন। ৩৬ বছরের পুরনো সেই আইন ব্যাপক সংশোধন ও যুগোপযোগী করে নতুন মোটরযান আইন পাস হয় বিগত সরকারের সংসদের শেষ অধিবেশনে। সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করেই নতুন এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু আইনটি যখন বাস্তবায়নের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো তৎপরতা শুরু করল বিপত্তিটা ঘটলো তখনই। আইনটি সংশোধনের দাবিতে শ্রমিক, মালিক ও পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষ সুবিধাভোগী গোষ্ঠী দেশব্যাপী পরিবহন ধর্মঘট ডেকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলল। অনেকেই ভাবে আন্দোলনটি শুধু শ্রমিকদের ছিল। কিন্তু এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কেননা এই আইন শ্রমিক ও যাত্রী অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে মালিকদের অনেক বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে এসেছে। ফলে এই ধর্মঘটে মালিক ও খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যে মদদ ছিল সেটি অনুমেয়।
প্রায় এক যুগ আগেই নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু কিছু অদৃশ্য কারণে সেটি আলোর মুখ দেখছিল না। তবে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাসের জন্য ব্যাপক জনমত তৈরি হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের ওপর চাপ আসতে থাকে। ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সড়ক পরিবহন আইনটি সংসদে পাস হয়। ইউরোপীয় দেশগুলোর মডেল অনুসরণ করে একটি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াসে ক্ষেত্রবিশেষে অনেক কঠোর বিধি-নিষেধ ও জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে আইনটিতে। মূলত এমন একটি আইন বাস্তবায়নের জন্য যে প্রস্তুতি ও কৌশল সরকার এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের প্রয়োজন ছিল তা নেই বললেই চলে।
প্রথমত, আইনটি পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অসাধু একদল শ্রমিক আইনের অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচার করে সাধারণ শ্রমিকদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। কিন্তু দুয়েকটি ধারায় কঠোর শাস্তি বা জেল-জরিমানার ব্যাপার থাকলেও সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে যে, সেটি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয় অর্থাং ওভারটেক, ওভারলোড, ফিটনেসহীনতা বা মোটরযানের নকশা পরিবর্তনজনিত কারণে হয়ে থাকে শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে। অন্যদিকে এসব কারণের মধ্যে অনেকগুলোর জন্য শুধু চালক নয়, মালিকও দোষী সাব্যস্ত হবেন। কিন্তু শ্রমিকদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে সারাদেশের যান চলাচল বন্ধ করে কার্যত সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয়। দেশের আপামর জনসাধারণের দাবি, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে জিম্মি করে নতুন আইনের প্রয়োগকে শিথিল করানো হলো।
আইনটি প্রণয়নের আগে বিআরটিএ’র উচিত ছিল- আইনের ইতিবাচক দিকগুলো বিশেষ করে শ্রমিক ও যাত্রী অধিকার সংক্রান্ত এবং জেল-জরিমানার বিষয়গুলো লিফলেট আকারে জনগণের মাঝে বিতরণ করে তাদের সচেতন করে তোলা। একটি বিষয় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাথায় আসা উচিত- আইনের গেজেট জনসাধারণ কিংবা শ্রমিকরা কিনে পড়ে না। দেখা যাচ্ছে, কোনো অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পরে সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে আইন বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত আইন খোঁজা শুরু করেন। তারা জানতে চান, অপরাধের শাস্তি কী! কিন্তু সরকারের উচিত কোনো আইন প্রণয়নের আগে অপরাধের সাজা সম্পর্কে মানুষকে জানানো। তবেই সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমবে। কিউরের চেয়ে প্রিভেনশন-ই তো কাম্য।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন হওয়া উচিত ছিল বিআরটিএ’র বিরুদ্ধে। তাদের সড়ক অবরোধ না করে অবরোধ করা উচিত ছিল বিআরটিএ অফিস। শিক্ষার্থীদের দল বেঁধে চালকের লাইসেন্স চেক করতে দেখেছি। কিন্তু গলদ যখন গোড়ায় তখন আগার যত্ন নিয়ে লাভ কী! যেখানে কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে পরীক্ষা ছাড়া ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স পাওয়া যায় সেখানে কীভাবে আমরা এমন চালকদের উপর ভরসা করতে পারি? সুতরাং বিআরটিএ-তে আগে শুদ্ধাচার আনতে হবে। তা না হলে যতই কঠোর আইন হোক না কেন তার সুফল আসবে না। আর একটি ব্যাপার হলো বিআরটিএ’র সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আমি শিক্ষানবিশ লাইসেন্সের আবেদন করি। কিন্তু আমার ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় দেওয়া ঠিক একবছর পরে। ধরে নিলাম আমি ব্যবহারিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেলাম। তারপরও মূল লাইসেন্স হাতে পেতে আমার আরও মাস চারেক সময় লাগবে। কেননা এই সময়ের মধ্যে ছবি তোলা ও বায়োমেট্রিক ফিঙ্গার দেওয়ার ব্যপার আছে। তাহলে এই দেড়বছর কি কোনো চালক সড়কে যাবে না? তার গাড়ি কি অব্যবহৃত থাকবে? এই যদি হয় বিআরটিএ’র সক্ষমতা তাহলে নিরাপদ সড়ক অধরা থেকে যাবে।
এক্ষেত্রে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার মডেল ফলো করা যেতে পারে। সেখানকার উপজেলা প্রশাসন জেলা বিআরটিএ অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে এনে অনস্পট শিক্ষানবিশ সনদ প্রদান করছে এবং একটা তারিখ নির্ধারণ করে দিচ্ছে ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য। সেখানে কোনো দালাল ও ঘুষ ছাড়া অল্প সময়ে উপজেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় লাইসেন্স প্রদানের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। দেশের অন্য উপজেলাগুলোতে এই মডেল ফলো করা যেতে পারে। এজন্য একটি ক্রাশ প্রকল্প গ্রহণ করা যায়। এতে স্বল্প সময়ে দেশব্যাপী ওয়ান স্টপ লাইসেন্স দেওয়া যাবে।
সড়ক পরিবহন খাতের শ্রমিক ও মালিক সিন্ডিকেটের কাছে যে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সাধারণ মানুষ ভয়াবহভাবে জিম্মি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কার্যকর বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এবং সেটি অবশ্যই সরকারি খাতে হতে হবে। বিআরটিসিকে শক্তিশালী করতে হবে এবং রেল যোগাযোগের বাইরে থাকা জেলাগুলোকে অবিলম্বে এই যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। আন্তঃজেলা বাসের মতো একই রুটে নির্ধারিত সময় পর পর ট্রেন ছাড়তে হবে। সেজন্য দেশব্যাপী ঢাকা-চট্রগ্রাম রুটের মতো ডুয়াল রেললাইন বসাতে হবে।
বিআরটিসির জন্য যে বাস কেনা হয় সেখানে কমিশন বাণিজ্য করতে চায় না অথবা ভারত থেকে নিম্নমানের বাস নিয়ে আসা হয়। তারপরে দেখা যায়, দুয়েকবছরের মধ্যেই অধিকাংশ বাস লক্কর-ঝক্করে পরিণত হয়। এগুলোতে আন্তঃজেলা চলাচলের মত আয়েশি আসনও থাকে না। তারপরও এই বাসগুলো দূরের রুটে ব্যবহার করা হয়। যে কারণে রাষ্ট্রীয় এই সড়ক পরিবহন যাত্রী আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিসি জাপান থেকে টেকসই বাস আমদানি করে যাত্রীবান্ধব করতে পারে।
নিরাপদ সড়ক শুধু যাত্রীদের জন্য না, চালক-শ্রমিকদের জন্যও। সবাই নিরাপদে ঘরে ফিরুক। সবার স্বাভাবিক মৃত্যু চাই। সেজন্য নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষক, ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]