মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানি মঙ্গলবার থেকে
৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ২২:৩৫
ঢাকা: রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নিপীড়নের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শুনানি শুরু হচ্ছে মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর)। নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের এই আদালতে মামলাটি দায়ের করে গাম্বিয়া। মামলায় গাম্বিয়াকে সহযোগিতা করবে বাংলাদেশ, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, এই মামলা কতদিন ধরে চলতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিতে মিয়ানমারের প্রতি আইসিজে’র অর্ন্তবর্তীকালীন কঠোর আদেশ প্রত্যাশা করছে আর্ন্তজাতিক মহল।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালত এক বার্তায় জানিয়েছে, গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার প্রথম দিনের শুনানিতে মঙ্গলবার গাম্বিয়া তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করবে। পরদিন বুধবার (১১ ডিসেম্বর) মিয়ানমার বক্তব্য রাখবে। তার পরদিন বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) প্রথমার্ধে মিয়ানমারের যুক্তি খণ্ডন করবে গাম্বিয়া, দ্বিতীয়ার্ধে গাম্বিয়ার যুক্তি খণ্ডন করবে মিয়ানমার।
সূত্রগুলো জানাচ্ছে, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতর বিচারকের সংখ্যা ১৫ জন। এই মামলার শুনানিতে তাদের প্রত্যেকেই উপস্থিত থাকবেন। তিন দিনের টানা শুনানি শেষে আদালত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেবেন। এই আদেশের পর তার বাস্তবায়ন প্রতিবেদন পরবর্তী চার মাসের (অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারির তারিখের পরদিন থেকে) মধ্যে গাম্বিয়া ও মিয়ানমার— উভয়কেই দাখিল করতে হবে।
গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীর কার্যালয় এক বার্তায় জানিয়েছে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রাখাইনে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক আদালতে শুনানি করতে পুরো প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে গাম্বিয়ার পক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন। তার সঙ্গে থাকবেন আর্ন্তজাতিক আইনে প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডসসহ একাধিক আইনজ্ঞ।
মিয়ানমার বিষয়ক কানাডার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বব রি এক বার্তায় বলেন, ‘আইসিজে আদালতে শুনানিতে অংশ নিতে এরই মধ্যে হেগে পৌঁছেছি। রাখাইনে ঘটে যাওয়া গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে কানাডা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। মিয়ানমারের ঘটানো এমন লজ্জাজনক বিষয়ের বিচার নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ায় কানাডার সরকারের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ এবং একই সঙ্গে গর্ববোধ করছি।’
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলায় কানাডা-নেদারল্যান্ডসের সমর্থন
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইসিজে আদালতের শুনানিতে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ হিসেবে থাকছে না। তবে গাম্বিয়াকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে এরই মধ্যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল ঢাকা থেকে হেগে গিয়েছে।
অন্যদিকে, এই মামলার বিরুদ্ধে লড়তে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ, কূটনীতিকদের নিয়ে শক্তিশালী দল গঠন করেছে মিয়ানমার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি।
গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গত ১১ নভেম্বর আইসিজে’র কাছে মামলা দায়ের করে গাম্বিয়া। এই মামলায় ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) গাম্বিয়াকে সমর্থন জানিয়েছে।
মামলার অভিযোগে গাম্বিয়া বলেছে, মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী কথিত সাফাই কর্মসূচির মাধ্যমে দেশটির রাখাইনে বসবাস করা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর অমানবিক নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, যৌন সহিংসতাসহ একটি জাতিকে চিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে এবং এখনও সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি জাতিসংঘের অনুসন্ধানকারী দলের তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেহেতু গাম্বিয়া ও মিয়ানমার দুইটি রাষ্ট্রই জাতিসংঘের গণহত্যা সনদে সই করেছে, তাই গণহত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী গত ১১ অক্টোবর এ বিষয়ে জানতে চেয়ে মিয়ানমারকে কূটনৈতিকপত্র দেয় গাম্বিয়া। মিয়ানমার এর কোনো জবাব না দেওয়ায় গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে বাধ্য হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের লক্ষ্য করে অভিযান চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। ওই অভিযানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা, ধর্ষণ ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠনের অভিযোগ উঠে। অভিযানের মুখে ১১ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। সে সময় মিয়ানমারের সেনাসদস্য, পুলিশ ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী রোহিঙ্গাদের নিধনে সরাসরি অংশ নিয়েছে বলে জাতিসংঘের তদন্তে প্রমাণ মিলেছে। আন্তর্জাতিক মহল রাখাইনে মিয়ানমারের ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
রাখাইনে ওই অভিযানের পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের একাধিক চুক্তি সই হলেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে দৃশ্যত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মিয়ানমার। একাধিকবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর তারিখ নির্ধারণ করা হলেও সেসব তারিখে কোনো রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিয়ানমারের পদক্ষেপের অভাবেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক আদালত আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত গণহত্যার অভিযোগে মামলা গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি রাখাইনে গণহত্যা রোহিঙ্গা সংকট