মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলন থেকে জেনোসাইড ট্রাইব্যুনালে
১০ ডিসেম্বর ২০১৯ ১২:৪২
এক সময় তাকে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষার দূত হিসেবে ভাবা হতো—গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় মিয়ানমারের সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গৃহবন্দী জীবন কাটিয়েছেন বছরের পর বছর।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখায় ১৯৯১ সারে সুচিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও দেওয়া হয়। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার দিন কমিটির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছিলেন, ‘ক্ষমতাহীনের ক্ষমতা অং সান সুচি।’
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানি মঙ্গলবার থেকে
মিয়ানমার ২০১৬ সালের পর থেকে গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করলে দেশটির ‘ডি ফ্যাক্টো’ বা অনানুষ্ঠানিক নেতা হন সুচি। এর পর থেকে বদলে যেতে থাকে তার কর্মকাণ্ড। একসময় যে বিশ্ব নেতারা তার পক্ষে ছিলেন তারও মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন সুচির কর্মকাণ্ডে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও তাদের বাড়ি-ঘড়ে অগ্নি সংযোগ করে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিলেও তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেননি অং সান সুচি।
তার কিছু আন্তর্জাতিক সমর্থন মনে করছেন সুচি একজন কার্যসিদ্ধিমূলক রাজনীতিবিদ। মিয়ানমারে বহু জাতি গোষ্ঠির মানুষ বসবাস করে। সেখানে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠির মানুষের রোহিঙ্গাদের প্রতি কোনো সহনুভূতি নেই। তারা আরও মনে করছেন, সেনাবাহিনী এখনো দেশটির মূল রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলায় কানাডা-নেদারল্যান্ডসের সমর্থন
তবে সমালোচকরা মনে করছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে নৈতিক অবস্থান হারিয়েছেন সুচি। তার মতো এত ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে ব্যক্তিগত ক্ষতি উপেক্ষা করেও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত ছিল।
ক্ষমতার পথে:
বর্তমানে ৭৩ বছর বয়সী সুচি মিয়ানমারের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন করায় ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সাল থেকে গৃহবন্দী ছিলেন। এর ফলে তিনি বিশ্বব্যাপী শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতীক হয়ে দাঁড়ান।
দীর্ঘ ২৫ বছর পর ২০১৫ সালে তার রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) থেকে নির্বাচন করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। তবে প্রকৃত বিজয় আসে আরও পাঁচ বছর পর যেদিন তিনি ১৫ বছরের গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান।
তবে মিয়ানমারের সংবিধানে বিধি-নিষেধ থাকায় তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। সুচির সন্তান বিদেশি নাগরিক হওয়ার কারণে সংবিধান অনুযায়ী তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। তার পরিবর্তে ‘ডি ফ্যাক্টো’ লিডারে পরিণত হন। তার অফিসিয়াল পদবি স্টেট কাউন্সিলর। প্রেসিডেন্ট উইন মেইন্ট তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
রাজনৈতিক পরিচিত:
আধুনিক মিয়ানমারের জাতির জনক জেনারেল অং সানের কন্যা সু চি। মিয়ানমারের স্বাধীনতার ঠিক ছয় মাস আগে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে জেনারেল অং সানকে আততায়ীরা হত্যা করে। সেসময় সু চির বয়স ছিল মাত্র দুবছর। ১৯৬০ সালে সু চি তার মায়ের সঙ্গে ভারতে চলে যান এবং সেখানে দিল্লিতে মিয়ানমারের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিযুক্ত হন।
এর চার বছর পর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে ফিলোসফি, পলিটিক্স ও ইকোনোমিক্সে পড়ালেখা করেন। অক্সফোর্ডে পড়াকালীন মিশেল অ্যারিসের সঙ্গে পরিচয় ও পরে বিয়ে করেন।
জাপান ও ভুটানে সফর ও পড়ালেখা শেষে তিনি যুক্তরাজ্যে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। সেখানে তার দুই সন্তান অ্যালকজ্যান্ডার ও কিমের জন্ম হয়। তবে তখনো তার চিন্তা জুড়ে ছিল মিয়ানমার।
এরপর ১৯৮৮ সালে তিনি তার অসুস্থ্য মায়ের দেখা-শোনা করার জন্য রেঙ্গুনে (বর্তমানে ইয়াঙ্গুন) চলে আসেন। সেসময় মিয়ানমার জুড়ে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান চলছিল। দেশটিতে গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা, কর্মচারী-কর্মকর্তা ও ভিক্ষু রাজপথে নামেন।
১৯৮৮ সালের ২৬ আগস্ট সু চি ঘোষণা দেন, ‘দেশের এই অবস্থায় আমার পিতার কন্যা হয়ে নিশ্চুপ থাকতে পারি না’। তার এই ঘোষণা তৎকালীন সেনা শাসক জেনারেল নি উইনের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনকে আরও বেশি বেগবান করে।
পরবর্তীতে অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধী ও যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট লিডার মার্টিন লুথার কিংয়ের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে অহিংস আন্দোলন পরিচালনা করেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী র্যালি ও শোভাযাত্রা করেন।
তবে ১৯৮৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর তাদের এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করে। এরপরের বছর সু চিকে গৃহবন্দী করে।