মরণেও তিনি দান করে গেলেন
১১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:০০
ঢাকা: অধ্যাপক অজয় রায়। ১৯৪৮ সালে যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন তখন থেকেই জড়িয়ে পড়েন মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে। সেই শুরু, এরপরে একে একে জড়িয়েছেন দেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে।
১৯৫১ সালে মহারাজা গিরিজা নাথ হাই ইংলিশ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন অজয় রায়। এরপর একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার কারণে কলেজে থাকা অবস্থায় মাসখানেক জেল খাটেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু সশস্ত্র যুদ্ধই করেননি, শিক্ষক সমিতি গড়ে তুলেছিলেন যা বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরেও তিনি বসে থাকেননি। নিভৃতে কাজ করে গেছেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে রেখেছিলেন নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ছাপ। আজীবন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখা মানুষটি লড়াই করেছেন সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ধারণ করে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। নির্ভয়ে ছুটে যেতেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সব সংগঠনের আয়োজিত যে কোনো আন্দোলনে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বভৌমত্বের পক্ষে সবসময় সোচ্চার থাকা অধ্যাপক অজয় রায় ছিলেন তার সমসাময়িক শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম একজন শিক্ষক। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান চর্চায় কাজ করে গেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।
ব্যক্তিজীবনে একজন পদার্থবিদ, বৈজ্ঞানিক হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন নৃতত্ত্ববিদও। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস নিয়েও তিনি কাজ করেছেন নিভৃতে। তার লেখনিতে ফুটে উঠতো বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার কথা।
মুক্তবুদ্ধি চর্চার আন্দোলন করে গেছেন তিনি আমৃত্যু। সেই লড়াইকে তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন দেশের তরুণদের মাঝেও। আন্তর্জাতিক ভাবে খ্যাত অধ্যাপক অজয় রায়ের সুযোগ ছিল সপরিবারে স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাসের। কিন্তু তিনি বলতেন, ‘এই দেশ আমরা স্বাধীন করেছি। এই দেশ আমাদের, এই দেশ ছেড়ে কেনো বাইরে যাবো আমরা?’
সেই দেশেই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির হামলায় হারিয়েছেন ছেলে অভিজিৎ রায়কে। পুত্রশোকে ভেঙ্গে পড়লেও আদর্শের লড়াই থেকে বিচ্যুত হননি অজয় রায়। বলেছিলেন, ‘আমার সন্তান আদর্শের লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছে। এটি গর্বের বিষয়, কারণ আদর্শের কখনো মৃত্যু নেই।’
আজীবন কাজ করেছেন দেশের জন্য, মানুষের জন্য। এমনকি মৃত্যুর পরেও সেই ধারা বজায় রাখলেন তিনি। নিজের মরদেহ দান করে গেলেন ইব্রাহীম মেডিকেল কলেজ ও বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য।
মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) অজয় রায়ের ছেলে অনুজিত রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল তার মরদেহ যেনো ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও বারডেম হাসপাতালে দান করা হয়। যাতে সেটি দেশের তরুনরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য ব্যবহার করতে পারে। সেটিই করা হয়েছে।’
এর আগে সোমবার (৯ ডিসেম্বর) বেলা ১২ টা ৩৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন একুশে পদক জয়ী অধ্যাপক অজয় রায়।
শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অধ্যাপক অজয় রায়ের মরদেহ দুপুরে নেওয়া হয় বারডেম হাসপাতালে। সেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষে মরদেহ গ্রহণ করেন ডায়েবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের পরিচালক (প্রোকিউরমেন্ট অ্যান্ড কর্পোরেট) মুহাম্মদ আবু তাহের খান।