‘দূষিত বাতাসের শহর’
১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ১০:৫৮
ঢাকা: নীলনদের কন্যা কায়রোকে বলা হয় ‘বাতাসের শহর’। এইভাবে নামকরণ করা হলে বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী শহর ঢাকার বর্তমান নাম হবে ‘দূষিত বাতাসের শহর’। শীতের উতলা হাওয়ায় উড়ে আসা ধূলিকণার কারণে এই দূষণের মাত্রা এখন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইটভাটা, যানবাহন আর কল-কারখানার চিমনি ছুঁয়ে বের হওয়া বিষাক্ত ধোঁয়ার বলয়। এই বিষ বলয়ের প্রভাবে রাজধানীর বাসিন্দারা এখন ঠিক মতো নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না! স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে কয়েক কোটি সাধারণ মানুষ।
দেশি-বিদেশি বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, গত এক দশকে ঢাকায় দূষণের মাত্রা ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। এই দূষণের কারণ হিসেবে জনসংখ্যার অতি ঘনত্ব ও অপরিকল্পিত নগরায়ণকে দায়ী করছেন তারা। ঘনবসতি বিবেচনায় ঢাকাকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত।
বৃহস্পতিবার বিকেলেও (১২ ডিসেম্বর) এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা ছিল ২০৪। পরিবেশ অধিদফতর বাতাসে দূষণের এই মাত্রাকে আনহেলদি বা অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে এই মাত্রা চলতি মাসে আরও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। চলতি মাসের প্রথম দিনে দূষণের মাত্রায় দুনিয়ার সব শহরকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল ঢাকা। সেদিন বাতাসে দূষণের মাত্রা ছিলো ৩১৫। বাতাসের গুণমান সূচক বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুসারে যেটি ছিলো ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর।
এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) সূচক অনুযায়ী, ৩০০-৫০০ সূচকে থাকা শহরগুলো বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আর ২০০-৩০০ খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং এটি জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কাবস্থার সূচক। ঢাকায় এখন রোজকার বায়ু দূষণমান এই দু’টি সূচকেই উঠানামা করে। এই সূচকে ০-৫০ পর্যন্ত বায়ু মানকে সন্তোষজনক বা ঝুঁকিহীন বলা হয়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘কয়লা, ও বিবিধ জ্বালানি পোড়ানোর ফলে ক্ষতিকর কণার সৃষ্টি হয়। ইটভাটা, শিল্প কারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়ার কারণে এসব ক্ষতিকর ক্ষুদ্রকণা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে সরাসরি ফুসফুসে ঢুকে মানুষের রক্তকণিকায় মিশে যায়। এর ফলে নানা জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। এসব রোগ স্বল্পসময়ে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।
দূষণের মাত্রার ভয়াবহ এই বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে ঢাকার চারপাশে সচল থাকা ইটভাটা, রাস্তাঘাটের ধূলা আর যানবাহনের অতি আধিক্যকে দায়ী করেছেন পরিবেশ অধিদফতরের বায়ুমান বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর আবুল কালাম আজাদ।
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঢাকার চারপাশে এত বেশি ইটভাটা যে এদের ধোঁয়ার কারণে নির্মল বাতাস পাওয়া এখন অসম্ভব। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুড়ি, মেট্রোরেলের ধূলা আর গাড়ির ধোঁয়া। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরকিল্পনা করে এগোতে হবে। দায়িত্বশীল প্রতিটি বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে ঢাকার বাতাসকে বিশুদ্ধ করা সম্ভব।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ঢাকায় ধূলা সবচেয়ে বড় সমস্যা। রাস্তা খোঁড়াখুড়ির কারণের এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাতাসের সঙ্গে মিশে যাওয়া ধূলার কণাগুলো নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের ফুসফুসে গিয়ে জমা হচ্ছে। যেখানে কার্বন, সালফেট, নাইট্রেটসহ সীসার মতো বিপজ্জনক পদার্থের উপস্থিতিও পাওয়া যাচ্ছে। এটি এখনি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে কিছুদিন পর ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তে হবে আমাদের।’
এই পরিবেশবিদ আরও জানান, ইট ভাটায় নিম্নমানের কয়লা পোড়ানো, রাস্তাঘাট মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় অপরিকল্পিতভাবে খোঁড়াখুড়ি, ভাঙাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, ভবন নির্মাণ বা ভাঙার সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা-ফুটপাতে ফেলে রাখা, মেশিনে ইট ভাঙ্গা, এবং যানবাহনের ধোঁয়ার পাশাপাশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ু দূষণের অন্যতম উৎস।’ তবে দূষণ বন্ধ করতে পরিবেশ অধিদফতর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে বলেও জানান তিনি।
অধিদফতরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পনের দিনে ঢাকার পার্শ্ববর্তী পাঁচটি জেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালদের মাধ্যমে ১৬টি অভিযান চালিয়ে অবৈধ ইটভাটার মালিকদের ২ কোটি ৪ লাখ টাকা জরিমানা ও ৫৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঢাকার বাতাসকে এই ইটভাটাগুলোই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিষাক্ত করছে বলে জানিয়েছেন বিভাগটির পরিচালক রুবিনা ফেরদৌস। একই অভিযোগে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকেও তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট বিভাগের পরিচালক রুবিনা ফেরদৌস বলেন, ‘ইটভাটার ধোঁয়া ঢাকাকে সবচেয়ে বেশি নাজুক করে তুলেছে। এজন্য অবৈধ ইটভাটাগুলোকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। তাদের মোটা অংকের জরিমানা করা হচ্ছে। এছাড়া আমরা মেট্রোরেলের ঠিকাদারদেরও জরিমানা করেছি। এভাবে যদি অভিযান পরিচালনা করা যায় তাহলে ঢাকার পরিবেশ আবারও স্বাস্থ্যকর করে তোলা সম্ভব।’
রুবিনা ফেরদৌস আরও বলেন, ‘নির্মাণকাজে প্রচুর ধূলা হচ্ছে কারণ দেশের প্রচলিত আইন কেউ মানছে না। দূষণ নিয়ন্ত্রণে ওই আইনের তদারকি বাড়াতে হবে। সারা দেশের ইটভাটাগুলোতে আধুনিকায়ন করতে হবে। ঢাকার বড় রাস্তাগুলোতে সকাল-বিকাল পানি ছিটাতে হবে। আবর্জনা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বৈজ্ঞানিক উপায়ে করতে হবে। যত্রতত্র ময়লা ও প্লাস্টিক পদার্থ পোড়ানো যাবে না।’
বায়ু দূষণের সূচকে নভেম্বরে ঢাকা সবার ওপরে জায়গা করে নিলেও গত পনের দিনের এই অভিযানে বাতাসের মান কিছুটা উন্নত হয়েছে বলেও জানিয়েছেন রুবিনা ফেরদৌস। দূষণ সূচকে ঢাকার অবস্থান এখন চতুর্থ। সবার ওপরে রয়েছে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোর। এরপরই আছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। বৃহস্পতিবার এ দুটো শহরে দূষণের মাত্রা ছিলো ২৮৭ ও ২৫৪।
তবে ঢাকার বাতাসে মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান পিএম ২.৫ শনাক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, পিএম ২.৫ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এর কারণে ফুসফুসের ক্যান্সারও হতে পারে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত পিএম ২.৫ নিঃসরণে চীন ছিল শীর্ষে। গত দুই বছরে চীনকে টপকে ওই দূষণকারী স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভারত। এরপরই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান।
পরিবেশ অধিদফতরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে যে নির্মাণকাজগুলো হচ্ছে, তাতে সকাল ও বিকেল দুই বেলা নির্মাণসামগ্রী, বিশেষ করে বালু ও ইট পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু রাজধানীর বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রেখে ধূলা সৃষ্টি করছে।