Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধুলায় ধূসর বন্দরনগরী


১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৪:৩৭

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে বাতাসে বস্তুকণা মিশে সৃষ্ট দূষণের পরিমাণ গত তিন বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যে বায়ু দূষণের জন্য ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ শহরের তালিকায় উঠে এসেছে চট্টগ্রামের নাম। পরিবেশ অধিদফতর বলছে, বায়ু দূষণের এই হার কোনোভাবেই আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। বাড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

বাতাসে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি বস্তুকণা ছড়ানোর জন্য একসময় লোহা ও সিমেন্টের কারখানাগুলোকে দায়ী করা হতো। কিন্তু এখন সেই মাত্রা আশংকাজনক হয়ে ওঠার জন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছে চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশের এলাকায় চলমান সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পকে। পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘পাইপলাইন বসানোর জন্য চট্টগ্রাম নগরী জুড়ে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি এবং সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন, আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে দূষণ ক্রমাগত বাড়ছে।’

চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদফতরের দূষণের মাত্রা নির্ধারণকারী গবেষণাগারের পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, যেসব জায়গায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হচ্ছে, বড় আকারের খোঁড়াখুঁড়ি যেখানে হচ্ছে, সেখানকার বাতাসে দূষণের পরিমাণ বেশি। কারখানার মতো সেখানেও প্রলম্বিত বস্তুকণা বাতাসে পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে চলতি বছরে দূষণের পরিমাণ আমরা বলছি যে, অতীতের রেকর্ডে এরকম দূষণ আর হয়নি।’

পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (মেট্রো) সংযুক্তা দাশগুপ্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কারখানাগুলোকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করছি, তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যাচ্ছে। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা সেটা করতে পারছি না। বিশেষত রোড কনস্ট্রাকশনের কাজটা আমাদের খুবই ভোগাচ্ছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। সেগুলো থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে মিশছে এবং দূষিত করছে।’

সারা বিশ্বে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধুলিকণার পরিমাণ ০-৫০ মাইক্রোগ্রাম ভালো, ৫১-১০০ মধ্যম, ১০১-১৫০ সতর্কাবস্থা, ১৫১-২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-৫০০ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

চট্টগ্রামে পরিবেশ অধিদফতরের গবেষণাগার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম নগরীতে বাতাসে গড়ে ধুলার পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৩২ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৮ সালে ছিল ২৫৫ থেকে ২৬০ মাইক্রোগ্রাম। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত গড়ে ধুলার পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩০৯ মাইক্রোগ্রাম।

 

বুধবার (১১ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম নগরীতে বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২৮২ মাইক্রোগ্রাম ধুলিকণা পরিমাপ করা হয়, যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বলছে পরিবেশ অধিদফতরের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (সিএএসই) প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ ও খুলশীর ফয়’সলেকের দুটি মনিটরিং স্টেশন থেকে বায়ু দূষণের পরিমাপ করা হয়। সম্প্রতি নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার নাসিরাবাদ এলাকায় আরও একটি স্টেশন চালু করেছে পরিবেশ অধিদফতর।

পরিচালক নূরুল্লাহ নুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘খুলশী এলাকায়ও বাতাসে এমনভাবে প্রলম্বিত বস্তুকণা পাওয়া যাচ্ছে, যা আমরা অতীতে দেখিনি। সেখানে দিনের মধ্যে কিছুটা সহনীয় থাকে। কিন্তু রাত ১২টার পর দেখা যাচ্ছে, ২২০ থেকে ২৩০ মাইক্রোগ্রাম পাওয় যাচ্ছে। অথচ সেখানে ১৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়ার কথা না। এটা নিয়ে জরিপ করে আমরা দেখেছি, রাত ১২টার পর থেকে খুলশীতে ট্রাক চলাচল বেড়ে যায়। মাটিবোঝাই ট্রাক চলে, কালো ধোঁয়া থাকে। এর বাইরে নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ৪০০ থেকে ৮০০ মাইক্রোগ্রাম ধুলিকণাও বাতাসে পেয়েছি।’

নুরী আরও জানান, এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম নগরীতে বাতাসে সবচেয়ে বেশি বস্তুকণা মিশছে চেরাগি পাহাড়, জামালখান, সাগরিকা ও কালুরঘাট এলাকায়। চেরাগি পাহাড় ও জামালখানে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। আর কালুরঘাট আরাকান সড়ক ও সাগরিকায় সিটি করপোরেশন সড়ক সম্প্রসারণ ও সংস্কার করছে।

সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্তা সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) পরিবেশ অধিদফতরের টিম সাগরিকা ও কালুরঘাট এলাকায় পরিদর্শনে গিয়ে বায়ু দূষণের প্রমাণ পেয়েছে। সিটি করপোরেশনকে বায়ুতে ধুলার মানমাত্রা বেশি পাবার কথা জানিয়ে বৃহস্পতিবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের দূষণ রোধে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

এর আগে, গত ৪ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বায়ূ দূষণ রোধে করণীয় নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছে। এতে বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া চলমান প্রকল্পের কাজের সময় পানি ছিটিয়ে ধুলা যাতে উড়তে না পারে সেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

নুরুল্লাহ নুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে অর্থাৎ যেসব প্রকল্প একেবারে নতুন করে শুরু হবে, সেগুলোর কাজ শুরুর আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধতকতা আছে। কিন্তু সরকারি প্রকল্প হওয়ায় এই শর্ত মানছে না কোনো সংস্থা। সরকারি কাজ হওয়ায় আমরা সরাসরি কোনো অ্যাকশনেও যেতে পারছি না। তারপরও আমরা বৈঠকে বলেছি যে, উন্নয়ন কাজের জন্য যে পরিমাণ দূষণ ইতোমধ্যে হয়েছে, এটা অনেক বেশি। এটাকে আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। আর বেশি হলে আমরা জরিমানা করব।’

পানি সরবরাহের পাইপালাইন বসানোর জন্য চট্টগ্রাম নগরী জুড়ে খোড়াখুড়ির জন্য সমালোচনা চলছে চট্টগ্রাম ওয়াসার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বায়ূ দূষণের বিষয়টি আলোচিত হয়ে ওঠায় এবং পরিবেশ অধিদফতর কঠোর হওয়ায় গত কয়েকদিন ধরে ওয়াসা তাদের খোঁড়া গর্তের আশপাশে পানি ছিটাতে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, ‘সড়কে যানবাহনের আধিক্য এবং যানজটের কারণে পানি ছিটানো যাচ্ছে না।’

সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মেয়র বায়ূ দূষণের জন্য দায়ী করছেন বহুতল ভবন নির্মান কাজকেও। গত ৩ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে মেয়র বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে। সেবা সংস্থাগুলো করছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আমরাও করছি। নগরবাসীর অনেকেও নির্মাণকাজ করছেন। সমস্যা হচ্ছে, সবাই নির্মাণ সামগ্রীগুলো রেখেছেন উন্মুক্ত স্থানে। এজন্য বায়ূ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা যাতে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়, সেজন্য সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছি, সময় বেঁধে দিতে। এর মধ্যে সামগ্রী সরিয়ে না নেয়, তাহলে জরিমানা করব। আইন প্রয়োগ করা গেলে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে।’

পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তা নুরুল্লাহ নুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট কোম্পানি বহুতল ভবন বানাচ্ছে। ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে বানাচ্ছেন। আমাদের আইনে কিছুটা সমস্যা আছে। নয়তলা পর্যন্ত ভবনের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র লাগে না। এজন্য আমরা সরাসরি কোনো অ্যাকশনে যেতে পারি না। ভবন মালিকরাও আইনের অপব্যবহার করে ছাড়পত্র না নিয়েই ১০-১৫ তলা ভবন বানাচ্ছেন।’

পরিবেশ অধিদফতরের হিসেবে বাতাসে বস্তুকণা ছড়ায় ১৮টি লোহা ও ৯টি সিমেন্ট প্রস্তুতকারকসহ মোট ২৭ টি কারখানা আছে চট্টগ্রাম নগরীতে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীতে আছে ৮টি।

অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্ক্র্যাপ লোহা থেকে বিলেট উৎপাদন করে এমন ৬টি কারখানা আছে নগরীতে। ২টি সিমেন্ট কারখানা আছে। এই কারখানাগুলোর আশপাশের এলাকায় বাতাসে প্রলম্বিত বস্তুকণার পরিমাণ বেশি। আমরা নিয়মিত সেখানে অভিযান করি। বাতাসে ধুলিকণার পরিমাপ করি। মানমাত্রার চেয়ে বেশি পেলে জরিমানা করি।’

চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ, বাদামতলীর মোড়, বিমানবন্দর সড়কের বিভিন্ন অংশ, বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট, অলঙ্কার মোড়, এ কে খান, জামালখান, বাকলিয়া, শাহ আমানত সেতুর শহরের প্রান্তসহ বিভিন্ন এলাকায় ধুলার কারণে পথে নেমে অস্বস্ত্বিতে পড়তে হচ্ছে লোকজনকে। বিশেষ করে গণপরিবহনের যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে।

চিকিৎসকদের মতে, বাতাসে ভয়াবহ দূষণের চরম শিকার হচ্ছেন শিশুরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রণব কুমার চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। দূষিত বায়ূ এবং বেশির ভাগ সংক্রামক রোগের জীবাণু তাদের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করছে। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, অ্যাজমা, ব্রংকিউলাইটিস, ঘন ঘন জ্বর-সর্দি-কাশি, কানের প্রদাহ, বসন্ত এমনকি যক্ষ্মাও ছড়াচ্ছে দূষিত বায়ূ। এছাড়া শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া রুদ্ধ হচ্ছে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিও নষ্ট হচ্ছে। আমরা বোধহয় পরিণামটা বুঝতে পারছি না। এর পরিণাম কিন্তু ভয়াবহ।’

চট্টগ্রামে বায়ু দূষণ ধুলাবালি বাতালে ধুলিকণা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর