কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ‘সাদামাটা চমক’ আসছে আওয়ামী লীগে
১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৫:২২
ঢাকা: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আসন্ন ২১তম ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন। আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর দলটির ২১তম জাতীয় সম্মেলন হবে। টানা মেয়াদে সরকারের ধারাবাহিকতার সরকার ও দলের মধ্যে সাংগঠনিক গতিশীলতাকে আরও সুসংহত করার অভিন্ন লক্ষ্যে সাদামাটা আড়ম্বরে সম্মেলন করতে যাচ্ছে। আসন্ন সম্মেলনে একমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে সভাপতি পদে অপরিহার্য রেখে বাকি পদে কারও বহাল, কারও পদোন্নতি এবং নতুন মুখের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তো নতুন করে কিছু করে না। যদি আপনারা ধারাবাহিক সম্মেলন দেখেন, অতীতে ২০টি জাতীয় সম্মেলন হয়েছে। সম্মেলনগুলো বিশ্লেষণ করলে উত্তর পাবেন। প্রতিটি সম্মেলনে ২০ থেকে ৩০ ভাগ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা বাদ পড়েছে। যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন, যারা অনিয়ম করেছেন, তারা বাদ পড়েছেন। সে জায়গায় নতুনদের অন্তর্ভুক্তির সমন্বয়ে কমিটি হয়েছে। আগামীতেও এর ব্যত্যয় ঘটবে বলে, আমি মনে করি না।’
তরুণ ও নারী নেতৃত্বের আকার কমিটিতে বাড়বে কি না—জানতে চাইলে ফারুক খান বলেন, ‘নারী সদস্য সংখ্যা বাড়বে। এটি আমাদের কমিটমেন্ট। এরইমধ্যে দলে নারী নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং নারী নেতৃত্ব, তরুণ নেতৃত্ব বাড়বে বলে আমি মনে করি।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক সম্প্রতি যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণ ও উত্তর সহযোগী ও মহানগর সম্মেলনে নেতৃত্ব পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘এর মধ্যে যে নেতৃত্বের যেভাবে পরিবর্তন এসেছে। তা থেকে বোঝা যায় যে, নেতৃত্বের একটি বিরাট পরিবর্তন হচ্ছে। একটি পদে পরিবর্তন হবে না, সেটি হচ্ছে আমাদের নেত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।’
দলের একাধিক নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, টানা মেয়াদে সরকারে থাকার ফলে ‘সরকার টু সংগঠন’ এবং ‘সংগঠন টু জনগণ’ এর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তাই এবার আসন্ন সম্মেলনে ‘কেন্দ্র টু তৃণমূল’ ‘তৃণমূল টু কেন্দ্র’র মধ্যে সংগঠনকে সুসংহত করার অভিপ্রায় নিয়ে সাদামাটা সম্মেলনেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে মূল্যায়িত হচ্ছেন দুর্দিন-দুঃসময়ের ত্যাগী, পরীক্ষিত ও ক্লিন ইমেজের নেতারা। মুজিববর্ষ উদযাপন এবং আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে জনগণের কাছে আরও বেশি অপরিহার্য করার লক্ষ্যেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে একঝাঁক গ্রহণযোগ্য তরুণ মুখমুখসহ নারী নেতৃত্বের আকার বাড়ছে। বাদ পড়তে যাচ্ছেন অনেকে।
বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই পুনঃনির্বাচিত হবেন? না তার জায়গায় অন্য কেউ স্থলাভিসিক্ত হতে যাচ্ছেন তা নিয়ে দলীয় ঘরানায় জোর জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। তবে দলের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আবারও বহাল থাকবেন।
আরেকটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, একমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অপরিহার্য। বাকি নেতৃত্ব কাউন্সিল অধিবেশনেই চূড়ান্ত হবে। সাধারণ সম্পাদক কে হবেন সেটিও কাউন্সিলে নির্ধারিত হবে। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে বহাল ও পদোন্নতি পেতে যাচ্ছেন অনেকে। যারা এরইমধ্যে যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে টানা তিন সম্মেলনে দায়িত্বে ছিলেন, তাদের পরিবর্তনের সম্ভাবনাই বেশি। তাদের অনেকের পদোন্নতি হচ্ছে। সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে অন্তত দুই জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হতে যাচ্ছেন। আর ৮ সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে ২টি বাদ রেখে ৬টি পদেই আসতে পারে নতুন মুখ। বর্তমান কমিটির দুজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ঠাঁই পাচ্ছেন সভাপতিমণ্ডলিতে। সম্পাদকমণ্ডলির বিভিন্ন পদেও কেউ বহাল থাকবেন আবার অনেক নতুন মুখ আসবে। বর্তমান কমিটির বেশ কয়েকজন সভাপতিমণ্ডলির শারীরিক অসুস্থতা বা বয়সজনিত কারণে বাদ পড়তে যাচ্ছেন। তাদের কারও কারও ঠাঁই হবে দলের উপদেষ্টা পরিষদে।
দলীয় সূত্র জানায়, সরকার এবং দল; বিষয়টিকে মাথায় রেখে কারও কারও ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির একাধিক পদে থাকার বিষয়টি রেখেও কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন হবে। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা নেতারা মূল্যায়িত হতে যাচ্ছেন। যারা মনোনয়ন চেয়ে পাননি কিংবা মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তবে গত সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও বোন শেখ রেহানা কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসতে পারেন বলে আলোচনা ছিল কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। তবে এবার প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা হোসেনের (পুতুল) নাম কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না, এই প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডি রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘একটা পদে কোনো পরিবর্তন আসবে না; সেটি হচ্ছে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি ছাড়া আর কেউই অপরিহার্য না। দল কীভাবে চলবে, কাকে দিয়ে চলবে, সেটি তিনি জানেন।’
২০১৬ সালে সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয় ওবায়দুল কাদেরকে। তার আগে এই পদে ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
এবার ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে গড়তে সোনার দেশ, এগিয়ে চলেছি দুর্বার, আমরাই তো বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে এরইমধ্যে বিভিন্ন স্থানে পোস্টার টাঙানো হয়েছে। সম্মেলনের উদ্বোধনী ও কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। বিকেল তিনটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলেনর উদ্বোধনী অধিবেশন হবে। পরের দিন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
সম্মেলন প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে ১১টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে ৪ ডিসেম্বর বুধবার আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে কেন্দ্রীয় নেতারা বক্ততা না করলেও ২৫ জনের মতো জেলা পর্যায়ের নেতা বক্তৃতা করেন। তাদের মূল কথা ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজীবন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেবেন। তার বিকল্প দলে কেউ নেই। অন্যান্য পদে গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ ভাবমূতির্র নেতাদের দেখতে আশাবাদী তারা।
সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় ১/১১ এর ধাক্কার পর ২০০৯ সালের সম্মেলনে দলের নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ২০১২ সালের পরের সম্মেলনে তেমন পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু ২০১৬ সালে সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলন আলোর ঝলকানি ও সাজসজ্জায় জাঁকজমকপূর্ণ করা হয়।
ওই সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক পদে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পরিবর্তে ওই কমিটির সভাপতিমণ্ডলির সদস্য ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন।
বর্তমান কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়া ১৭ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলিতে তিনটি পদ এখন ফাঁকা। বর্তমান কমিটির চারজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে তিনজন প্রায় ১০ বছর ধরে একই পদে আছেন। তাদের কেউ কেউ সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে আলোচনায় রয়েছেন। তবে যুগ্ম সম্পাদকদের কেউ কেউ সভাপতিমণ্ডলিতে ঠাঁই পাবেন। এর বাইরে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে জ্যেষ্ঠ কাউকে কাউকে দলের সভাপতিমণ্ডলিতে ফিরিয়ে আনা হতে পারে বলেও জোর গুঞ্জন রয়েছে। আট জন সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে ছয়জন গত তিন মেয়াদে একই পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাদের মধ্যে দু-তিনজনের পদোন্নতি হতে পারে। দু-একজনকে বাদ পড়তে পারেন।
এ ক্ষেত্রে সাংগঠনিক সম্পাদকদের একটা বড় অংশই নতুন মুখ হতে পারে। বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকদের ১৯টি পদের ৭-৮টি পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় সদস্য পদেও নতুন কিছু মুখ অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ২৮ জন। এখান থেকেও একটা বড় অংশ বাদ পড়তে পারে। তাদের জায়গায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং বিভিন্ন জেলার প্রবীণ নেতারা জায়গা পেতে পারেন। এ ছাড়াও নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিটি পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব ২০২০ সালের মধ্যে নিশ্চিত করার কথা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এবার আসন্ন সম্মেলনে নারী নেতৃত্বের আকার বাড়ছে।
বর্তমান কমিটিতে ১৫ জন নারীনেত্রী রয়েছেন। দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান কমিটির সদস্য সংখ্যা ৭৭। এ হিসাবে বর্তমান কমিটিতে নারী নেতৃত্বের হার ১৯ শতাংশ।