‘চোখ বন্ধ করলে দেখি, বাবা রক্তাক্ত হাতে সাদা ভাত মাখাচ্ছেন’
১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ২১:১২
ঢাকা: `আমি চোখ বন্ধ করলে দেখি, বাবা তাঁর রক্তাক্ত হাতে সাদা ভাত মাখাচ্ছেন। সাথে দুটো কাঁচা মরিচ আর পেঁপে ভাজি। দেশকে ভালোবাসবার যে অঙ্গীকার, তা তিনি শেষ ভাত খাওয়ার সময় আমাদের দিয়ে গেছেন। সেভাবেই আমি বাংলাদেশকে ধারণ করি।’— বলেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ।
শনিবার (১৪ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। ‘তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে তা আজ বাংলাদেশ’ শিরোনামে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে আওয়ামী লীগ।
শাওন মাহমুদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মানুষের সামনে যখন আসি তখন মনে হয় আমি আমার ঘরে এসেছি। আশেপাশের মানুষগুলো সবাই আমার চেনা। সবচেয়ে বেশি নিরাপদ লাগে তখন। কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য লাগে এবং স্বস্তি পাই। আমাদের বোঝবার মানুষগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।’
শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান হিসাবে আওয়ামী লীগ সভাপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন বলেন, ‘আপনি না থাকলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কোনোটাই সম্পন্ন হত না। সেই ১৯৭২ সালের এই দাবিটাকে জানি না কীভাবে আপনি এতো শক্তভাবে তুলে ধরেছেন। আমাদের যারা মা, যারা শহীদ জায়া আছেন তারাতো দেখে যেতে পারছেন।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি একজন অলৌকিক মানুষ আখ্যা দিয়ে শাওন বলেন, ‘আমাদের দেশে একজন অলৌকিক নেতা ছিলেন। যাকে আমরা জাতির পিতা বলি। আমার মাতা-পিতার পিতা, আমার পিতা, আমার সন্তানের পিতা, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কন্যা, সেই বংশের যে একজন বাতি, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমাদের আপা, সন্তানের বন্ধু। এই রকম অদ্ভুত একটা পরিবার, আমার মনে হয় না রাজনীতিতে আর কোথাও আছে। যেখানে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ থেকে সবাই আপা ডাকেন তাকে। বুবু ডাকেন। জাতির পিতাকে পিতা ডাকেন। এ এক গর্বিত দেশের গল্প।’
জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার বীজমন্ত্র ও বেদবাক্য হিসেবে মেনে থাকেন বলেও জানান তিনি। শাওন বলেন, ‘যুদ্ধের আগে ভাষা আন্দোলন থেকে আমাদের দেশে অলৌকিক কিছু মানুষ ছিল। যারা গান গাইতেন, সুর করতেন, চলচ্চিত্র বানাতেন, সংবাদ সংগ্রহ করতেন, লেখালেখি করতেন, কবিতা লিখতেন, শিক্ষক ছিলেন, ডাক্তার ছিলেন। এই পুরো এক ঝাঁক মানুষ জাতির পিতার ৭ই মার্চের ভাষণের পর কিন্তু সরাসরি বুঝেই গিয়েছিলেন, দেশ স্বাধীন করতে হবে। আমাদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্ম দিতে হবে।’
বুদ্ধিজীবী হত্যা যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রি থেকে শুরু হয়েছিল তার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘কবি মেহেরুন নেসা; উনি ৭ই মার্চ জাতির পিতার ভাষণ শোনার পর বাসায় এসে কবিতা লিখেছেন। ‘বুলেট আর বেয়নটের ঝড় ঠেলে জনতা জেগেছে।’ ২৩ মার্চ উনি দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে জয় বাংলা বাসার ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন। তাঁর ভাগ্যে সেই জয় বাংলা আর বলা হয়ে ওঠেনি। ২৭ মার্চ বিহারীদের নেতৃত্বে পাকহানাদার বাহিনী তাঁকে হত্যা করে।
শহীদ বাবার সন্তান হিসাবে পিতার নিহত হওয়ার পটভূমি উল্লেখ করতে করতে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন শাওন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আগস্টের শেষদিকে একজন ক্র্যাক গেরিলা ধরা পরার পর সে সবার নাম বলে দিয়েছিল। শহীদ রুমী, শহীদ জুয়েল, বদি হাফিজ, আজাদ, আলতাফ মাহমুদ। ২৭ আগস্ট থেকে ধরপাকড় শুরু হয়ে যায়। প্রত্যেকের বাসায় গিয়ে একে একে ধরতে থাকে। আমার বাবা ২৯ তারিখ সারাদিন তার ব্ল্যাক মরিস একটা গাড়ি ছিল সেটা দিয়ে সারা ঢাকা শহর চষে ফেলেছিল। চেনা গেরিলাদের খবর দেওয়ার জন্য। তোমরা পালিয়ে যাও। সারাদিন সে কিছু খায়নি। রাতের দিকে যখন বাসায় এসেছিল- মা বলেছিল, ভাত খাও। সারাদিন খাওনি। বাবা বলেছিল, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। অনেক ছেলের খোঁজ পাচ্ছি না। আমার ভালো লাগছে না। মা ভাত টেবিলে রেখে আমাকে নিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ভোরবেলা একদম আযান হওয়ার পর পর পাকহানাদার বাহিনী বাসা ঘেরাও করে। এর পর ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করে, আলতাফ মাহমুদ কোন হ্যায়? বাবা দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমি আলতাফ মাহমুদ। বাবাকে যখন নিয়ে যাচ্ছিল- মার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, এত ভয় পাও কেন?’
শাওন আবারও বলতে থাকেন- ‘এরপর তো আর বাবার খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমার মামা ফিরে এসেছিল। মামাদের বাঁচিয়ে দিয়ে গিয়েছে বাবা। আমি বছর তিনেক আগে বলেছিলাম, আচ্ছা বাবা শেষ খাবার কি খেয়েছিল? ভাত খেতে এত ভালোবাসত। মামা বলেছিল, সে কাঁচা মরিচ, ডালভাত ও পেঁপে ভাজা খেতে ভালোবাসত।’
আলোচনা সভার শুরুতে শোকাবহ ১৫ আগস্টে নিহত সকল শহীদ, জাতীয় চার নেতা, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ মুক্তিযুদ্ধে নিহত সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দলের অন্য নেতাদের মধ্যে উপদেষ্টাপরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, বেগম মতিয়া চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, আবদুল মতিন খসরু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও আবু আহম্মেদ মান্নাফিও বক্তৃতা করেন। যৌথভাবে সভা পরিচালনা করেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।