স্মৃতি বর্তমান- মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় এক নাটক
১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৯:২৩
বাংলাদেশ টেলিভিশনে যখন যোগদান করি সেই ১৯৮০ সালে তখন জিয়াউর রহমান শাসন ক্ষমতায়। আগস্ট ১৯৭৫ এর পর থেকে টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু’র নাম উচ্চারন করা যেতোনা। এরশাদের সামরিক শাসন আমলেও না। কোনোরকম দায়সারাভাবে পালিত হতো স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস। ‘পাকিস্তান বাহিনী’ বা ‘পাক বাহিনী’ শব্দ দু’টির উচ্চারন নিষিদ্ধ ছিলো। তবে ‘হানাদার বাহিনী’ বলা যেতো।
‘স্বাধীনতা দিবস’ বা ‘বিজয় দিবস’ এর কোনো অনুষ্ঠানে একটু সত্য উচ্চারিত হলে পাকিস্তান হাই কমিশন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আপত্তি জানাতো। আমরা প্রযোজকেরা মন্ত্রণালয় হতে কড়া বার্তা পেতাম। তবে সে সময় অধিকাংশ সচিব, যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা ছিলেন যারা নেপথ্যে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতেন। সেই সব আমলারা মাঝে মাঝে আমাদের উদ্ধার করতেন কোনো সমস্যায় পড়লে।
একবার মনে আছে,তখন ১৯৮৯। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলছে। শ্রদ্ধেয় আব্দুল্লাহ আল-মামুন আমাকে একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নাটক করতে বললেন স্বাধীনতা দিবসে। হাতে সময় নেই। নামী দামী নাট্যকারদের কাছে স্ক্রিপ্ট চাইবার মতো পর্যাপ্ত সময়ও নেই। তাই একরাতে বসে লিখে ফেললাম শহীদ বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে একটি বিশেষ নাটক ‘স্মৃতি বর্তমান’। হাতে সময় কম। নাটকে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বুলবুল আহমেদ ও মেঘনা। এছাড়া ছিলেন কামালউদ্দিন নীলু, ওবায়দুল হক সরকার সহ অনেক গুণী অভিনেতা।
রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ’৭১ এর বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে নাটকটি রচিত। বুলবুল আহমেদ ও মেঘনা নানা বুদ্ধিজীবিদের চরিত্রে রূপান্তরিত হতেন। নাটকে শহীদ ডাঃ আলীম চৌধুরী এবং তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী’র চরিত্রও ছিলো। শ্যামলী আপা তখন উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়য়ের অধ্যক্ষ। তিনি অনেক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। ঐ ঘটনার একটি চরিত্র মাওলানা মান্নান। যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ওবায়দুল হক সরকার।
যে সময়ে নাটকটি বিটিভি থেকে সম্প্রচারিত হয় সে সময়ে মাওলানা মান্নান ছিলেন এরশাদ সরকারের একজন মন্ত্রী। সুতরাং নাটকটি প্রচারিত হওয়ায় সরকার দারুন ক্ষেপলেন আমার উপর। বিটিভি থেকে আমার শাস্তিমুলক বদলি তখন প্রায় নিশ্চিত। সে সময় বিটিভি’র কর্ণধার ছিলেন সাইফুল বারী। তিনি নিজেও একজন কবি। এরশাদের ঘনিষ্টজন। তথ্য মন্ত্রণালয় আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করবে না সরাসরি শাস্তি দেবে এ বিষয়ে একটি সভা আয়োজন করা হয়েছে। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন সাইফুল বারী সাহেব সহ বিটিভি’র নাটক বিভাগের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল-মামুন।
সাইফুল বারী আমার বদলীর পক্ষে সিদ্ধান্ত দিলেন। তবে মামুন ভাই (আব্দুল্লাহ আল-মামুন) বেঁকে বসলেন। তিনি বললেন ‘শাস্তি খ ম হারূন কে কেনো দেবেন, আমাকে দিন। কারণ নাটকের স্ক্রিপ্ট আমিই অনুমোদন দিয়েছি।’ নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত ছাড়াই মিটিং শেষ হয়।
এরমধ্যে একদিন আমার বাসায় সরাসরি ফোন করলেন একজন প্রভাবশালী আমলা। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ছিলেন এবং জেলা গভর্নর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তিনি নিজেও একজন কবি ও লেখক। ভদ্রলোক আমার নাটকের খুব প্রশংসা করলেন এবং বললেন এ ধরনের সাহস যেনো আমি আগামীতেও অব্যাহত রাখি। তারা আমার পাশেই আছেন। পরে শুনলাম কয়েকজন আমলা আমার পক্ষে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব কে বলেছিলেন, আমার বিরুদ্ধে যাতে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থ গ্রহণ করা না হয়।
মজার বিষয় হলো সে সব আমালাদের আমি চিনতাম না। তারা নেপথ্যে থেকে সেই কঠিন সময়েও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে গেছেন।
এই নাটকটি ছাড়াও আজ আমার অনেক নাটকের কথাই মনে পড়ছে। আমার প্রযোজিত ধারাবাহিক শুকতারা, শঙ্কিত পদযাত্রা, চেনামুখ। মনে পড়ছে আরো অনেকগুলো নাটকের নাম, যা নিয়ে পরবর্তিতে আলোচনা করা যাবে।
খ ম হারূন: নাট্য নির্দেশক ও পরিচালক।
আব্দুল্লাহ আল মামুন খ ম হারূন বাংলাদেশ টেলিভিশন বিটিভি বুলবুল আহমেদ মুক্তিযুদ্ধ মেঘনা সাইফুল বারী স্মৃতি বর্তমান