মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর: তীর-ধনুক-বর্শায় পরাজিত শত্রুবাহিনী
১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ১২:৩৬
ঢাকা: ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শুধু ভারী অস্ত্রই ব্যবহৃত হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা কখনও কখনও তীর ধনুক ও বর্শাও ব্যবহার করেছেন। ঢাল ও বর্শা ব্যবহার করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এ দেশের সাধারণ মানুষেরা। ইতিহাসের সেই তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে আগারগাঁওয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।
বর্শা তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধের সময় বান্দরবানে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছিল ইপিআর। শত্রুবাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে জয়পুরহাটে আদিবাসীরা ব্যবহার করেছিল তীর ও ধনুক। ঢাল ও বর্শা ব্যবহার করে বরিশালে সাধারণ মানুষ হায়েনাদের প্রতিরোধ করেছিল। দেশের সব জায়গাতেই সাধারণ মানুষেরা এভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ করেছিল।
দর্শনার্থীদের ইতিহাসের এ সব কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই জাদুঘরের একটি গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে তীর, ধনুক, ঢাল ও বর্শা। যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত দেশীয় এসব অস্ত্র জাদুঘরে দান করেছেন গৌরাঙ্গ চন্দ্র মণ্ডল।
জাদুঘরে চারটি গ্যালারি রয়েছে। এসব গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক, গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও আলোকচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। ‘আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংগ্রাম’ নামকরণের প্রথম গ্যালারিতে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কালপর্বে এই জনপদের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রত্ননিদর্শন রয়েছে।
‘আমাদের অধিকার, আমাদের ত্যাগ’ শীর্ষক দ্বিতীয় গ্যালারিতে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ঘটনা থেকে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী সরকার গঠন পর্ব পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গ্যালারিতে ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বর্বরতার চিত্রও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়াও ৪ এপ্রিল কুষ্টিয়ার যুদ্ধ এবং সারাদেশের গণহত্যার নিদর্শন রয়েছে গ্যালারিতে। আরও রয়েছে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া বাঙালিদের শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাত্রা, সেখানে আশ্রয়, জীবনযাপনের ঘটনাবলি।
গ্যালারি ৩ ও ৪ এর নামকরণ করা হয়েছে ‘আমাদের যুদ্ধ, আমাদের মিত্র’ এবং ‘আমাদের জয়, আমাদের মূল্যবোধ।’ গ্যালারিগুলোতে বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালির প্রতিরোধ গড়ে তোলার নিদর্শন, মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, গণমানুষের দুরবস্থা, যৌথ বাহিনীর অভিযান, বিভিন্ন অঞ্চলে বিজয়, বুদ্ধিজীবী হত্যা, ঢাকায় পাকিস্তানি দখলদারদের আত্মসমর্পণের নিদর্শন রয়েছে। চারটি গ্যালারিই ক্রমানুসারে সাজানো হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে নারীরা সরাসরি অংশ নিয়েছেন। সহায়তা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সেই অবদানের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বাখুন্ডা সেতু ধ্বংসের অভিযানের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে একটি গ্যালারিতে। নৌকায় করে যাওয়া সেই অভিযানের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে এর ছাইয়ে। যুদ্ধের বর্ণনায় বলা হয়েছে, মধ্য অক্টোবরে ৬ সদস্যের একটি নৌ-কমান্ডো দল রাজবাড়ীর পাংশায় শিক্ষক আবদুর রশীদের বাসায় আশ্রয় নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মাইন ও এক্সপ্লোসিভ নিয়ে বিশ মাইল দূরে পদ্মার চরে পৌঁছানো এবং সেখানে অপারেশন পরিচালনা করা। নৌকার পাটাতনের নিচে রাখা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। ওই দলের সঙ্গে যোগ দেন আবদুর রশীদ খানের চাচি ও তার বালিকা কন্যা। বিভিন্ন সেতু অতিক্রমের সময় রাজাকারদের পাহারা এড়ানোর জন্য কমান্ডো দল আগে থেকেই নেমে পড়ত নৌকা থেকে।
আট বছরের বালিকা হাসনা খান রানী দাঁড়িয়ে থাকতে ছইয়ের সামনে। আর নৌকার ভেতরে থাকতেন তার মা। জিজ্ঞাসাবাদের জবাব দিতো বালিকা, মা ঘোমটা টেনে বসে থাকেন নীরবে। সাহসের সঙ্গে অস্ত্রবাহী নৌকা নিয়ে তারা পার হয়ে যায় রক্তচক্ষু পাহারা, পৌঁছে যান লক্ষ্যস্থলে। সফলভাবে পরিচালিত হয় ওই অভিযান।
কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নতুন চন্দ্র সিংহ। বিভিন্ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ রাউজানের এ বাসিন্দা সামাজিক কর্মকাণ্ডেও সম্পৃক্ত ছিলেন। দেশে গণহত্যা শুরু হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক সপরিবারে নতুন চন্দ্রের বাসায় আশ্রয় নেন। পরে তারা সীমান্ত পাড়ি দেন। তথ্যটি কোনোক্রমে স্থানীয় রাজাকাররা জেনে যায়। তাদের সহায়তায় পাকবাহিনী ২৩ এপ্রিল নতুন চন্দ্রের বাসায় ঢুকে তাকে গুলি করে হত্যা করে। সেই নতুন চন্দ্রের একটি কোট ও লাঠি স্থান পেয়েছে জাদুঘরে।
ধর্ম ও বিজ্ঞানের যোগসূত্র নিয়ে দর্শনভিত্তিক বিভিন্ন প্রবন্ধের রচয়িতা হরিণাথ দে। ‘ঈক্ষণ’ নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন তিনি। ২৭ মার্চ পুরান ঢাকার বাসা থেকে তাকে তুলে নেয় পাকবাহিনী। স্থানীয় আরও দশজন হিন্দু নাগরিকের সঙ্গে তাকে নিয়ে আসা হয় সূত্রাপুর থানাধীন সেনাক্যাম্পে। রাত ১০টার দিকে ধোলাই খালের ওপরে লোহার পুলে নিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন পুলের নিচে পাওয় যায় তার লাশ। হরিণাথ দে’র ব্যবহৃত একটি টেপ রেকর্ডার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে স্থান পেয়েছে।
নবদম্পতি রণজিৎ দে ও রাণী দে। কিন্তু ঘর-সংসার করা সম্ভব হয়নি তাদের। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে তাদের। রণজিতের অপরাধ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন পরিচালনায় বাবা মধুসূদন দে’কে সাহায্য করা। অন্ধকার সেই কালরাতে হত্যা করা হয় মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দে’ কে। মধুসূদনের স্ত্রীসহ পুরো পরিবারটিই বিশেষ টার্গেট হয়েছিল ইতিহাসের ঘৃণ্যতম অপারেশন সার্চলাইটে। হত্যা করা হয় এই পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে। গ্যালারিতে মধুসূদনের ব্যবহৃত শার্ট, রণজিতের স্ত্রী রাণীর শাড়ি, নিজ হাতে লেখা কবি মেহেরুন্নাসার পাণ্ডুলিপি, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার নোটবইসহ সেই সব ক্ষতচিহ্ন আলোকচিত্র ও নিদর্শনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
দ্বিতীয় গ্যালারিতে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি কক্ষে পাকবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনার ভিত্তি একটি ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে। অন্য একটি ছবিতে পাকসেনাদের কথোপকথনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘ওয়ারলেস কনভারসেশন বিটুইন কমান্ড হেডকোয়ার্টার অ্যান্ড লোকাল ইউনিট’ শীর্ষক ওই ছবিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ২৫ মার্চ রাতে কতজনকে হত্যা করা হয়েছিল, তার তথ্য পাওয়া যায়।
১৯৭১ এর ২ এপ্রিল বাংলাদেশের ৩৫ জন প্রতিনিধি জাতিসংঘের মহাসচিব উ. থান্ট-এর কাছে গণহত্যা বন্ধের জন্য আবেদন জানায়। যে টাইপরাইটারে সেই আবেদন লেখা হয়েছিল তাও প্রদর্শিত হচ্ছে এই গ্যালারিতে। ওই টাইপরাইটারটির দাতা হারুন হাবীব। জেনোসাইড এর নিন্দার প্রথম প্রতিক্রিয়াও সন্নিবেশিত আছে এই গ্যালারিতে। গ্যালারির একটি ছবিতে বলা হয়েছে, পাকবাহিনী পরিচালিত ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ যে জেনোসাইড এর লক্ষণ তার প্রথম প্রতিফলন মেলে ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে. ব্লাড কর্তৃক ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রেরিত গোপন বার্তায়।
২৮ মার্চ প্রেরিত টেলিগ্রামের শিরোনাম তিনি দেন ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’। ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্ট গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক সংসদীয় প্রস্তাব গ্রহণ করে। এর পরবর্তী ধারাক্রমও আছে এই গ্যালারিতে। অন্য একপাশে জাতীয় চার নেতার ব্যবহৃত পোশাক, চশমা ও লাইটারও প্রদর্শিত হচ্ছে। দেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হিন্দু কাঠমিস্ত্রী নির্মিত চাঁদ-তারা খচিত ভবেরপাড়া খ্রিস্টান মিশনের চেয়ারটি সংরক্ষিত আছে এখানে।
বাকি গ্যালারিতে তুলে ধরা হয়েছে যুদ্ধজয় ও স্বাধীনতার কথা। আরও তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন পর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, ব্যবহৃত অস্ত্র ও বীরত্ব গাথা।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রতিদিনই দর্শনার্থীর সমাগম ঘটছে। ডিসেম্বরে বেড়েছে দর্শনার্থীদের আগমন। এই দলে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাই বেশি। তরুণ-তরুণীরাও রয়েছেন। শিক্ষার্থীসহ তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা বলছেন, জাদুঘর ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ব হচ্ছেন তারা। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সম্মুখ নিদর্শন তাদের নাড়া দিচ্ছে আরও গভীরে।
তীর ধনুক বর্শা মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি