এগারোটি বধ্যভূমিতে ৪৮ বছরেও নির্মিত হয়নি স্মৃতিফলক
১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৬:৩৭
নেত্রকোনা: স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও অরক্ষিত ও অবহেলায় পড়ে আছে নেত্রকোনার বধ্যভূমিগুলো। এখনও সেখানে নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিফলক। বর্তমান সরকারের আমলে দেশের অনেক পরিবর্তন হলেও নেত্রকোনার বধ্যভূমিগুলোর কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও নেত্রকোনার সাধারণ মানুষ। স্মৃতিফলক নির্মিত না হওয়ায় নেত্রকোনার ছোট-বড় ১১টি বধ্যভূমির অধিকাংশই হারিয়ে যেতে বসেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নেত্রকোনা পৌরশহরের সাতপাই টেকনিক্যাল স্কুলের ভেতরে, পূর্বধলার ত্রিমোহনী কিংবা মোক্তারপাড়ার মতো স্থানেও নির্মাণ করা হয়নি স্মৃতিফলক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় এলাকার আলবদর ও রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ ও মুক্তিকামী অসংখ্য বাঙালিকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে এসব বধ্যভূমিতে ফেলে রাখত। ১৯৭১ সালে পাকসেনারা অসংখ্য মা-বোনকে ধরে নিয়ে এসব স্থানে নির্যাতনের পর হত্যা করত। অগণিত শহীদের রক্তে ভেজা এসব জায়গা সংরক্ষণের অভাব মুছে যেতে বসেছে। অনেকেই এসব স্থান অবৈধ দখলের পাঁয়তারা করছে। অযত্ন আর অবহেলায় এসব স্থান পড়ে থাকলেও তা সংস্কারের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। জাতীয় দিবস এলে কিছু কিছু বধ্যভূমির কদর বাড়লেও সারা বছরই এগুলো থাকে অযত্ন আর অবহেলায়।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ইতিহাসবিদ ও বিভিন্ন শহীদ পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ১৪টি বধ্যভূমির কথা জানা গেছে। এগুলো হচ্ছে- জেলা শহরের মোক্তারপাড়া সেতু সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর, সাতপাই সড়ক সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর, নেত্রকোনা-পূর্বধলা সড়কের ত্রিমোহনী, জেলা শহরের চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর, সদর উপজেলার চল্লিশা রেল সেতু, পূর্বধলা উপজেলার পুকুরিয়াকান্দা, জারিয়া রেলস্টেশন সংলগ্ন কংস নদীর তীর, রাজপাড়া গ্রামের ডা. হেম বাগচীর বাড়ি, দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি গ্রাম সংলগ্ন সোমেশ্বরী নদীর তীর, গাওকান্দিয়া, কেন্দুয়া উপজেলার ঘোড়াইল, ধূপাগাতি, সেনের বাজার ও কেন্দুয়া বাজার। এর মধ্যে পূর্বধলা উপজেলার ত্রিমোহনী এবং জেলা শহরের মোক্তারপাড়া সেতু সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর ও সাতপাই এলাকায় একই নদী।
এর মধ্যে পূর্বধলা উপজেলার ত্রিমোহনী এবং জেলা শহরের মোক্তারপাড়া সেতু সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর ও সাতপাই এলাকায় একই নদী তীরে তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হয়েছে। বাকি ১১টি বধ্যভূমি সম্পূর্ণ অরক্ষিত।
শহীদ পরিবারের সন্তান মো. আব্দুর রব রব্বানী বলেন, ‘আমার চাচা বদিউজ্জামান মুক্তা ও সিদ্দিকুর রহমানসহ যে ছয়জনকে বিরামপুর বাজারে হত্যা করা হয় সেই স্থানে আজও কোনো স্মৃতিফলক নির্মাণ হয়নি। যদি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হতো তাহলে আগামী প্রজন্ম তাদের সম্পর্কে জানতে পারতো।’
এ ছাড়াও ১৯৭১ এর ২২ সেপ্টেম্বর পূর্বধলার ত্রিমোহিনীতে সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল। সেদিন হানাদাররা সুরেশ সাহা, সতীশ সরকার, স্বদেশ দত্তসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৫জন নিরীহ মানুষকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করেছিল। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিগুলো পড়ে আছে অযত্নে আর অবহেলায়।
বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণসহ এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার দাবি জানান মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকাবাসী। নেত্রকোনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী বলেন, ‘স্বাধীনতার এত বছরেও কেন বধ্যভূমিগুলোতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি তা আসলে অবাক করার মতো বিষয়। আমি চাই এসব স্থানে শহীদদের নাম সম্বলিত স্মৃতিফলক নির্মাণ করবে প্রশাসন।’
সাবেক জেলা প্রশাসক ড. মুশফিকুর রহমান জেলার বধ্যভূমিগুলোতে স্মৃতিফলক নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দফরে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তবে প্রস্তাব বাস্তবায়ন আর হয়নি।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মঈন উল ইসলাম বধ্যভূমিগুলোতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা প্রসঙ্গে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বর্তমান সরকারের উচিত এসব স্থানে গুরুত্ব দিয়ে স্মৃতিফলক তৈরি করা। এ ব্যপারে আমি যতদিন এ জেলায় আছি সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করব।’