সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে আশা-চিন্তার দোলাচলে যারা
১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৬:১৫
ঢাকা: ২১তম জাতীয় সম্মেলনে কে হচ্ছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক? নাকি বর্তমান সাধারণ সম্পাদকই দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পাচ্ছেন- এ নিয়ে আগ্রহ ও কৌতুহলের কমতি নেই নেতাকর্মীদের। বর্তমান দায়িত্বের নয়, অন্য কেউ হতে যাচ্ছেন পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক- প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ভেতরে এমন আশাও করছেন অনেকে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘এক নেতা এক পদ বা দল ও সরকার’ পৃথক করার ফর্মুলা বাস্তবায়ন হলে বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের পরিবর্তে বেশ কয়েকজনের নাম আলোচনায় রয়েছে। তবে এর বাইরেও আশায় বুক বেঁধেছেন অনেকে। দলের একাধিক সূত্র সারাবাংলাকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আগামী ২০ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিকেল তিনটায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সম্মেলনের উদ্বোধন হবে। ২১ডিসেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চত্বরে দ্বিতীয় অধিবেশন শেষে আগামী তিনবছরে জন্য নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব পাবে। সম্মেলনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতুহল। বিশেষ করে এবার দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নীরবতা পদ প্রত্যাশীদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তারা দলীয় সভাপতির সঙ্গে ঘরোয়া সাক্ষাতেও কোনো ইঙ্গিত পাচ্ছেন না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নেতৃত্ব নির্বাচনের দায়িত্ব কাউন্সিলরদের। কিন্তু কাউন্সিলররা বরাবরই এ দায়িত্ব ন্যস্ত করেন সভাপতির ওপর। তাই পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক কে হবেন, তা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্তের ওপর।
এবারের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের পদে যারা আলোচনায় রয়েছেন তারা হলেন- আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। এর বাইরে আলোচনায় রয়েছেন সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য আজমত উল্লা খান। তবে ওবায়দুল কাদেরের পরে আবদুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান ও বাহাউদ্দিন নাছিমের নামই বেশি আলোচনায় আসছে।
রোববার (১৫ ডিসেম্বর) বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে স্বেচ্ছাসেবক ও শৃঙ্খলা উপকমিটির বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলকে নতুনভাবে সাজাতে চান। সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে।’
আগামী ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গণভবনে দলের বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যনিবার্হী সংসদের শেষ বৈঠক হবে। এর আগে গত ৪ ডিসেম্বর তিনবছর পর দলের জাতীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা জানান, টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকার কারণে কেন্দ্রের সাথে তৃণমূলের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো জেলা ও উপজেলায় গ্রুপিং দ্বন্দ্বে নিজেদের মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। সেই সুযোগে অনুপ্রবেশকারীরা দলে মজবুত অবস্থান সৃষ্টির পায়তারা করছে। আগামী বছর দেশব্যাপী মুজিববর্ষ উদযাপন ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে আরও জনবান্ধব এবং সুসংহত করার অভিপ্রায় রয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যার। তাই জাতির পিতার তৃতীয় প্রজন্মের উত্তরাধিকারের মধ্যে কেউ দলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। শেখ হাসিনা গত জাতীয় সম্মেলন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনের আগেও তার বয়সের দিকটি বিবেচনা করে দলীয় দায়িত্ব থেকে অবসর নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তিনি চান, আগামী দিনের আওয়ামী লীগ তৈরি করতে। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অঙ্গীকার অনুযায়ী প্রথমেই দলের নেতাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে নজির সৃষ্টি করেছেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এবারের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদের অথবা তাঁর পরিবর্তে যেই আসুক না কেন, তিনি মন্ত্রিপরিষদে থাকতে পারবেন না- এমন ইঙ্গিত রয়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার। বিশেষ করে গত ৩০ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পাকিস্তান আমলে মন্ত্রিত্ব ছেড়েছিলেন।’ এর পর থেকেই দলের ভেতর গুঞ্জন জোরালো হয়ে ওঠে।
সূত্র জানায়, গত শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে সাক্ষাৎ করতে যান একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত দুই যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান এবং সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। ওই সাক্ষাত প্রার্থী চার নেতাই জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি অবহিত ও পরামর্শের ফাঁকে ‘সাধারণ সম্পাদক’ পদ নিয়ে দলীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি। তিনি কেবল দল ও সরকার আলাদা করার পরিকল্পনার দিকে ইঙ্গিত দেন। তিনি চার নেতার উদ্দেশে বলেন, ‘আমি তো তোমাদের বলছি, বিষয়টি আমি দেখছি। যা যা কাজ দিয়েছি তা শেষ কর।’ ওই সাক্ষাতে উপস্থিত দুই নেতার কাছে জানতে চাইলে এ বিষয়ে তারা কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
প্রসঙ্গগত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত হলে দলের চার নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও বি এম মোজাম্মেল হককে ‘বিশেষ দায়িত্ব’ দেন শেখ হাসিনা। তিনি মনোনয়ন না পাওয়া চার নেতাকে দল জেতানোর দায়িত্বের পাশাপাশি নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী কমিয়ে আনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে দেখভালের দায়িত্বসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অপর্ণ করেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। সেই থেকে দলীয় ঘরানায় ‘চার খলিফা’ খ্যাত হয়ে ওঠেন তারা।
এদিকে রোববার (১৫ ডিসেম্বর) সম্মেলন প্রস্তুতি অভ্যর্থনা উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন স্থান পরিদর্শনে আসেন। এ সময় মঞ্চ ও সাজসজ্জা উপ-কমিটির আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সদস্য সচিব মির্জা আজম, খাদ্য উপ-কমিটির আহ্বায়ক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সদস্য সচিব কামরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক ও শৃঙ্খলা উপ-কমিটির সদস্য সচিব আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সংস্কৃতিবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য সচিব অসীম কুমার উকিল, দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, উপদফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদসহ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিন নেতারা নিজ নিজ উপ-কমিটির প্রস্তুতি নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন মোহাম্মদ নাসিম। এ সময় নাসিম বলেন, ‘নানকের গলাটা তো ভরাট ছিল। টেনশনে বোধহয় কমে গেছে। টেনশনে আছেন এরা। বোঝেন না। সবাই টেনশনে আছে, আমি ছাড়া। আমার কোনো টেনশন নাই।’ এর কিছুক্ষণ পর উপস্থিত হন মাহবুব উল আলম হানিফ। তাকে পাশের চেয়ারে বসার আহ্বান জানিয়ে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘ভাই আসেন, আমার কাছে আসেন। আপনারা সবাই টেনশনে আছেন।’ সম্মেলনের দ্বারপ্রান্তে জুনিয়রদের সঙ্গে এরকম হাস্যরসে মেতে ওঠেন নাসিম। এক পর্যায়ে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম পাশ থেকে বলেন, ‘বহুমাত্রিক টেনশন আছে।’
আরও পড়ুন: আ. লীগের সম্মেলন: নেতৃত্বে আসছে স্বচ্ছ ও মেধাবী মুখ
২০ ও ২১ ডিসেম্বর ২১তম জাতীয় সম্মেলন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান