আরেকটি ‘অনুভূতির’ সম্মেলনের দ্বারপ্রান্তে আওয়ামী লীগ
১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ১১:২২
ঢাকা: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম।’ সেই ‘অনুভূতির’ সম্মেলনের দ্বারপ্রান্তে আওয়ামী লীগ। আসছে ২০ ও ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউশনে দলটির ২১তম ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। বরাবরের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সভাপতি পদে অপরিহার্য ধরে তাঁর নেতৃত্বে পরবর্তী তিন বছরের জন্য নতুন একটি কমিটি গঠনের লক্ষ্যে সম্মেলনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ক্ষমতাসীন দলটি।
মঙ্গলবার (১৭ডিসেম্বর) দুপুরে সম্মেলনস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরেজমিনে দেখা যায়, সম্মেলনের প্রস্তুতি ঘিরে ব্যস্ত সবাই। কারও কোনোদিকে তাকানো অবসর নেই। প্রমত্ত পদ্মার বুকে ৪০টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে পদ্মাসেতু, সেটি এখন দৃশ্যমান প্রায়। পদ্মাসেতুর সামনের বিশাল জলরাশিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট নৌকা। একপাশে চরে জেগে আছে কাশবন। এমনই একটি আবহের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিশালাকার এক পালতোলা নৌকা। তাতে আবার জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রতিকৃতি। মূল মঞ্চের পেছনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ছবি ছাড়াও ঠাঁই পেয়েছে জাতীয় চার নেতা- তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম এ মনসুর আলী এবং এএইচ এম কামারুজ্জামানের ছবি। এছাড়া আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম চার নেতা- মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের ছবি রাখা হয়েছে সেখানে।
সম্মেলন প্রস্তুতির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সারাবাংলাকে জানান, সম্মেলনকে কেন্দ্র করে শত শত মানুষ নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পালিত হবে মুজিববর্ষ। দেশে-বিদেশে মুজিববর্ষের জাঁকজমক ও বর্ণিল আয়োজন সামনে রেখে গত সম্মেলনের তুলনায় এবার সাদামাটা সাজসজ্জার মধ্য দিয়ে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। কেবলমাত্র সম্মেলনস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে নজরকাড়া সাজসজ্জা ও আলোর ঝলকানি। সম্মেলনে এবার তাৎপর্যের দ্যুতি ছড়াবে মূল মঞ্চটি। মঞ্চটি করা হয়েছে বিশাল আকৃতির নৌকার আদলে। মঞ্চের সামনে রয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতুর আদল। মূল মঞ্চটি ১০২ ফুট দীর্ঘ, ৪০ ফুট প্রশস্ত। নৌকার পালগুলোতে থাকছে দলীয় প্রতীক ও দলীয় নেতাদের মুখচ্ছবি। সম্মেলনস্থলের ভেতরে চারপাশে থাকেব বাংলাদেশের জন্ম অভ্যুদয় থেকে আওয়ামী লীগের জন্ম ইতিহাসের পরিক্রমা সম্বলিত বিশাল বিশাল ব্যানার-ফেস্টুন। এছাড়াও থাকবে বিএনপি-জামায়াত জোটের আগুন সন্ত্রাস ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন নেতিবাচক রাজনীতির চিত্রায়ন।
সম্মেলনকে সফল করার লক্ষ্যে ১১টি উপ-কমিটি নেতারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তারা জানান, এবারের সম্মেলনে ব্যয় ধরা হয়েছে চার কোটি টাকা। সারাদেশ থেকে সাড়ে সাত হাজার কাউন্সিলর ও পনের হাজার ডেলিগেটসসহ ৫০ হাজার নেতা-কর্মী উপস্থিত থাকবেন। এ উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দলীয় সভাপতির ধানমন্ডির কার্যালয়ে উৎসাহ উদ্দীপনা ও উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। সম্মেলন সফল করতে দলের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, পোস্টার ও দাওয়াত কার্ড তৈরি হয়ে গেছে। অতিথিদের দাওয়াত দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজও শেষের দিকে। ১৮ ডিসেম্বর গণভবনে বর্তমান কেন্দ্রীয় শেষ কার্যনির্বাহী সংসদের সভা অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে গত ৪ ডিসেম্বর জাতীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এবারের সম্মেলনের স্লোগান- ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে গড়তে সোনার দেশ, এগিয়ে চলেছি দুর্বার, আমরাই তো বাংলাদেশ।’
সম্মেলনের অভ্যর্থনা উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিলের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। ২১ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দিনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তিন বছরের জন্য নতুন একটি শক্তিশালী ও গতিশীল কমিটি গঠন হবে। প্রতি বছর বিদেশি রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও এবার তা হচ্ছে না। কারণ, আগামী বছর মুজিববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। তবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।’
অর্থ উপ-কমিটি সূত্রে জানা যায়, এবার জাতীয় সম্মেলনে মোট বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ৪ কোটি টাকা। সম্মেলন উপলক্ষে গঠিত বিভিন্ন উপ-কমিটি তাদের ব্যয়ের সম্ভাব্য খরচ অর্থ-উপকমিটির কাছে জমা দিয়েছে।
গঠনতন্ত্র সংশোধনী উপ-কমিটির সদস্য সচিব আফজাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার গঠনতন্ত্রে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন নেই। সহ-সম্পাদক পদ না রাখার জন্য আমরা কাউন্সিল অধিবেশনে প্রস্তাব দেবো। এর বাইরে তেমন কোনো পরিবর্তন উল্লেখ করার মতো নেই। বিষয়ভিত্তিক উপ-কমিটির সদস্য থাকবে। তারা সেমিনার, আলোচনা ও কর্মশালা করবে, বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করবে এবং এগুলো সুপারিশ আকারে কেন্দ্রীয় কমিটিতে দাখিল করবে।’
মঞ্চ ও সাজসজ্জা উপ-কমিটির দায়িত্বে রয়েছেন দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও কেন্দ্রীয় সদস্য মির্জা আজম। এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘এবারের প্যান্ডেলটি অনেক বড়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এত বড় প্যান্ডেলে আর কখনও সম্মেলন আয়োজন হয়নি। আশা করি, ৫০ হাজারের বেশি মানুষ এই প্যান্ডেলের ভেতর বসতে পারবে।’
এছাড়া সম্মেলনের প্রথম দিন শুক্রবার হওয়ার কারণে মুসল্লিদের জুমার নামাজ আদায়ের দিকটি মাথায় রেখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নামাজ পড়ার বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে বলে জানান নানক। তিনি বলেন, ‘দশটা থেকে কাউন্সিলর-ডেলিগেটরা আসা শুরু করবে। জুমার নামাজের যেন বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য আলাদা একটি প্যান্ডেলে ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
মঞ্চ সাজসজ্জা কমিটি সূত্র জানায়, সম্মেলনস্থলে মোট ২৮টি এলইডি পর্দায় সম্মেলনের পুরো অনুষ্ঠান দেখার ব্যবস্থা থাকবে। একটি গেট ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত রেখে বাকি ৪টি গেট প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। মূল মঞ্চে চেয়ার থাকবে ৭৭টি। ৮১ সদস্যের মধ্যে চারটি পদ খালি রয়েছে। প্রথম সারিতে দুটি চেয়ারে বসবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দ্বিতীয় সারির চেয়ারে বসবেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও চার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। তৃতীয় সারির চেয়ারে সম্পাদকমণ্ডলী ও কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যরা বসবেন।
স্বেচ্ছাসেবক ও শৃংখলা উপ-কমিটির সদস্য সচিব ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘দেশের প্রাচীনতম ঐহিত্যবাহী সংগঠন আওয়ামী লীগ। যদিও এবার আমরা তত বেশি আড়ম্বরভাবে সম্মেলন করতে যাচ্ছি না। এরপরও দেশের তৃণমূলের নেতরা কাউন্সিলে অংশগ্রহণের জন্য আসবেন। সম্মেলনকে সফল করার জন্য শৃঙ্খলা একটি অন্যতম প্রধান বিষয়। সে লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবক ও শৃঙ্খলা উপ-কমিটির পক্ষ থেকে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা দুই হাজার স্বেচ্ছাসেবকের তালিকা তৈরি করেছি। তারা দায়িত্ব পালন করবেন।’
সাংস্কৃতিক উপ-কমিটির সদস্য সচিব ও দলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০ থেকে ২৫ মিনিট ইতিহাস নির্ভর, মুক্তিযুদ্ধ এবং আজকের বাংলাদেশ শিরোনামে গীতিনাট্য পরিবেশন করা হবে। এখানে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীরা থাকবেন। এছাড়াও থাকবেন তিন প্রজন্মের শিল্পীরা। এরা জাতীয় সংগীত, দেশাত্মবোধক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোরাস গান পরিবেশন করবেন। জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, সংস্কৃতি উপ-কমিটির চেয়ারম্যান নাট্যজন আতাউর রহমান, সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী খালিদ বাবু, শামীম আরা নিপা, শিবলী এরা সবাই মিলে দেখভাল করছেন। এছাড়াও সন্ধ্যায় এক মনোঞ্জ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।’
দলের সম্মেলনে আগত ২৫ হাজার অতিথিকে পাটের ব্যাগ উপহার দেবে প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটি। ওই ব্যাগে আওয়ামী লীগের ইতিহাস সম্বলিত স্মরণিকা, শোক প্রস্তাব, দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ভাষণ থাকবে।
খাদ্য উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও দলের কেন্দ্রীয় সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সারাবাংলাকে বলেন, এ মিলনমেলায় লোক হবে প্রায় ৫০হাজার। এই ৫০ হাজার লোকের খাবার ব্যবস্থা করার জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এবং কামরুল ভাইকে নির্দেশ দিয়েছেন। ২০ ডিসেম্বর হলো শুক্রবার। জুম্মার আগেই আমরা খাবার পর্বটা শেষ করতে চাই। আটটি বিভাগের জন্য আমরা ১০টি প্যান্ডেল থেকে খাবার বিতরণ করব। দশটা প্যান্ডেলে এক হাজার কর্মী কাজ করবে।’
দলের উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি যথাযথ কাউন্সিল করার জন্য যা যা উপাদান দরকার, তার সবকিছু থাকছে। সারাদেশের নেতারা আসবেন। গানের অনুষ্ঠান আছে। একটি পরিচ্ছন্ন কাউন্সিল অনুষ্ঠান মানুষ যাতে দেখতে পারে সেজন্য আমরা দলের পক্ষ থেকে সামগ্রিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। দাওয়াতের কাজ শেষ পর্যায়ে।