Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বন্দর-কাস্টম, সেনাবাহিনীতে নিয়োগের নামে প্রতারণার নিখুঁত জাল


১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৭:৫৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস এবং সেনাবাহিনীতে নিয়োগের নামে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে মোট অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত দু’টি চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এর মধ্যে একটি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতারের পর তাদের প্রতারণার প্রক্রিয়া নিয়ে পেয়েছে বিভিন্ন তথ্য।

পিবিআই জানিয়েছে, এই চক্রের প্রতারণার কাজটি খুবই নিখুঁত। সংস্থার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন করা, নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যানের সই করা প্রবেশপত্র দেওয়া, লিখিত, মৌখিক ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এমনকি পুলিশ ভেরিফিকেশন পর্যন্ত হয়। সব প্রক্রিয়া শেষে নিয়োগপত্র নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী যখন চাকরিতে যোগ দিতে যান, তখন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ততক্ষণে প্রতারক চক্র মোবাইল বন্ধ করে গা ঢাকা দেয়।

পিবিআইয়ের সন্দেহ, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরের কেউ কেউও জড়িত আছেন। প্রতারক চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের কারা জড়িত সেটাও তদন্তের আওতায় আনছে সংস্থাটি।

পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্দর, কাস্টমস এবং সেনাবাহিনীতে নিয়োগের নামে প্রতারণার তথ্য সংবাদপত্রে পেয়ে আমরা তদন্তে নামি। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকেও বিষয়টি তদন্তের অনুরোধ করে পিবিআইকে চিঠি দেওয়া হয়। তদন্তে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের দু’টি চক্রের সন্ধান আমরা পেয়েছি। একটি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা সরাসরি চাকরি দেওয়ার নামে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছি। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে প্রতারণার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যা জেনেছি, সেটা খুবই চাঞ্চল্যকর। এত নিখুঁতভাবে তারা কাজ করে, সেটা ভেতরের কারও সহযোগিতা না থাকলে করা সম্ভব নয়। আমরা সেটি নিয়েও তদন্ত করব।’

গ্রেফতার তিন জনের মধ্যে মো. রিপন সিকদারকে (৩০) গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকার সবুজবাগ থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই। রিপনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগরের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা।

এর আগে, রিপনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) রাতে নগরীর চৌমুহনী এলাকায় পূরবী হোটেলে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় আতিকুর রহমান চৌধুরী নাদিম (৩০) ও তোফাজ্জল হোসেনকে (৫৪)। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা একটি পেনড্রাইভে সংরক্ষিত তথ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং প্রতারণার পুরো বিষয় উদঘাটন হয়েছে বলে জানিয়েছেন সন্তোষ কুমার চাকমা।

তিনি জানান, প্রতারণার সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে রিপন সিকদারকে গ্রেফতারের পর ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে খুঁজে না পেয়ে পিবিআই নগর শাখার এসআই মো. জাহেদুজ্জামান বাদী হয়ে ডবলমুরিং থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় তিন জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

প্রতারিত হয়ে প্রতারণায় আতিকুর

গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে আতিকুর জানিয়েছেন, প্রায় ছয় বছর আগে মাদারীপুরের এক ব্যক্তিকে চট্টগ্রাম কাস্টমসে চাকরির জন্য ১৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন করেছিলেন তিনি। ওই ব্যক্তি তাকে প্রবেশপত্র এনে দেন। হোটেলে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। সিভিল সার্জনের অফিসে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়। ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সনদও জমা দেওয়া হয়। ওই ব্যক্তি তাকে তৎকালীন কাস্টমস কমিশনারের কাছেও নিয়ে গিয়েছিলেন। সব প্রক্রিয়া শেষে টাকা হস্তান্তরের পর যোগদান করতে গিয়ে জানতে পারেন, তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ছাড়া বাকি সব ডক্যুমেন্টেই ছিল ভুয়া। সেই ১৩ লাখ টাকা আর ফেরত পাননি আতিকুর।

পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতারিত হওয়ার পর আতিকুর ২০১৫ সাল থেকে নিজেই নেমে যান প্রতারণায়। নিজে প্রতারিত হওয়ার সময় প্রক্রিয়াগুলো শিখে নিয়েছিলেন তিনি। ছবি ঠিক রেখে আনোয়ার হোসেন নামে একটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। কাস্টমসের অভ্যন্তরীণ কারও কারও সহযোগিতা পান। ঢাকায় গিয়ে তোফাজ্জলের সঙ্গে পরিচয় এবং তার মাধ্যমে রিপনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।’

সন্তোষ জানান, রিপন ও তোফাজ্জলের কাজ ছিল দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেকার যুবকদের সংগ্রহ করে চট্টগ্রামে আনা। আর বাকি প্রক্রিয়াগুলোর সিংহভাগ করতেন আতিকুর, যাকে চাকরিপ্রার্থীরা আনোয়ার হোসেন নামে চিনতেন। মূলত মামলা তদন্তের সময় যেন সঠিক নাম-ঠিকানা খুঁজে না পেয়ে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, সেজন্য এই প্রতারণার আশ্রয় নেন আতিকুর।

গত ৯ সেপ্টেম্বর নীলফামারী থানায় অজয় ভট্টাচার্য নামে একজন প্রতারণার শিকার হয়ে মামলা করেন। ওই মামলায় আসামি হিসেবে আনোয়ার হোসেনের নাম আছে। পিবিআই জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছে, অজয় ও তার স্ত্রীর বড় ভাই মিলনের কাছ থেকে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে চাকরি দেওয়ার নামে ২৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই আতিকুর।

প্রতারণার জাল, প্রতারিত পুলিশও

পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন জানিয়েছেন, গ্রেফতার চক্রের সদস্যরা এ পর্যন্ত মোট ৫৩ জন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা করে নিয়ে প্রতারণা করেছে বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছেন তারা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে ২৩ জনের নামে ভুয়া প্রবেশপত্র ও এর মধ্যে ২০ জনের নামে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এবং ২১ জনকে তারা ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে একজনের নামে ভুয়া নিয়োগপত্র ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ইস্যু করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগের নামে চার জনকে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ২৭ জনের নামে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘পত্রিকায় সরকারি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে তারা চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করে। চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে ধাপে ধাপে টাকা হাতিয়ে নেওয়া শুরু করে। প্রথমে নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যানের সই করা প্রবেশপত্র দেয় তাদের হাতে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা পরীক্ষার তারিখের সঙ্গে মিল রেখে তাদের পরীক্ষা নেওয়া হয় নগরীর সেন্ট মার্টিন অথবা ল্যান্ডমার্ক হোটেলে। যথারীতি তাদের নিজেদের বানানো প্রশ্ন ও উত্তরপত্র দেওয়া হয়। এরপর বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী মৌখিক পরীক্ষায় বসানো হয় হোটেলেই। পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় তারা আসল জালিয়াতি করে।’

‘সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে যেভাবে সিল-স্বাক্ষর, স্ট্যাম্প লাগিয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য চিঠি পাঠানো হয়, তারাও একইভাবে চিঠি পাঠায়। সরকারি দফতরের চিঠি ভেবে পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর ক্লিয়ারেন্স সনদ পাঠিয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট দফতরে। চক্রের সদস্যরা সেই ক্লিয়ারেন্স সনদ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে যেকোনো উপায়ে বের করেন। একইভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন আসার পর প্রার্থীদের হাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যানের সই করা নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। নিয়োগপত্রটি দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে এবং লেনদেনের শেষ অঙ্কের টাকা গ্রহণ করে মোবাইল বন্ধ করে দেয় প্রতারকরা। সেই সিম তারা আর ব্যবহারই করে না। প্রার্থী চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারিত,’— বলেন সন্তোষ কুমার চাকমা।

তিনি জানান, আতিকুরের কাছ থেকে জব্দ করা পেনড্রাইভে প্রশ্ন, উত্তরপত্র, নিয়োগপত্র, প্রবেশপত্রের নমুনা পাওয়া গেছে। সেখানে বন্দর-কাস্টমসের কর্মকর্তাদের নাম, পদবি, সই, সিল একেবারে হুবহু পাওয়া গেছে। তবে যেসব স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করা হয়, তার সবাই জাল বলে জানতে পেরেছে পিবিআই।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন জানিয়েছেন, প্রতারক চক্রের সদস্যরা ব্যাংক, বিকাশ ও নগদে টাকা লেনদেন করে। রিপন সিকদারের বিকাশ অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও যাচাই-বাছাই করা হবে।

এছাড়া জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানকে দেড় বছর আগে ওএসডি করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতারণার ঘটনাগুলো তদন্তে আমরা মূলত সমস্যায় পড়ছি ভিকটিমকে নিয়ে। প্রতারণার শিকার কেউ যদি থানায় গিয়ে কোনো অভিযোগ করেন কিংবা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, তখন দালালচক্র তার টাকা ফেরত দিয়ে সমঝোতা করে ফেলে। ভিকটিম তখন আড়ালে চলে যান। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে করে প্রতারকরাও আড়ালে চলে যান। প্রতারণার শিকার সবাই যদি, আইনের আশ্রয় নিতেন তাহলে অনেক আগে এই চক্র শনাক্ত হতো এবং ধরা পড়ত।’

চাকরিতে নিয়োগের নামে প্রতারণা প্রতারক চক্র প্রতারণা ভুয়া নিয়োগ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর