Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বন্দুকযুদ্ধে নিহত নুরীর নেপথ্য কাহিনী


১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ২০:০৫

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুলে শনিবার দিবাগত রাতে গোয়েন্দা পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত নুর ইসলাম ওরফে নুরী আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি বড় গ্যাংয়ের হয়ে কাজ করতেন বলে জানা গেছে।  গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, এই গ্যাং পরিচালিত হয়ে আসছে বর্তমানে যুবলীগের একজন নেতা ও সাবেক এক ছাত্রদল নেতার যৌথ নেতৃত্বে। রাজধানীতে অন্তত দুটি খুনের সঙ্গে নুরীর সরাসরি সম্পৃক্ততার তথ্যও রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে।

বিজ্ঞাপন

শনিবার দিবাগত মধ্য রাতে ডিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নুরী নিহত হওয়ার পর, রোববার দিনভর সারাবাংলার অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে আসে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, নুরী একজন পেশাদার খুনি হিসেবেই আন্ডারওয়ার্ল্ডে পরিচিত ছিলেন।

গত ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীতে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক সিদ্দিক হোসেন মুন্সি হত্যাকাণ্ডে নুরী সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। সে রাতে নুরী ও তার কয়েকজন সহযোগী সিদ্দিকের চেম্বারে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। তাতে সিদ্দিক ঘটনাস্থলে নিহত হন। এতে গুলিবিদ্ধ হন আরও তিন জন। এরপর গত শনিবার দিনে দুপুরে নুরী হাতেই খুন হন রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকার বাদশাহ নামের আরেক মাদকব্যবসায়ী। তবে ওই ঘটনার পর এলাকাবাসী নুরীকে হাতেনাতে ধরে ফেলে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে ‍তুলে দেয়। রাতেই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন নুরী।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) অতিরিক্ত উপ কমিশনার (এডিসি) সাকলায়েন শিথিল, শনিবারের বাড্ডা হত্যাকাণ্ড এবং গত ডিসেম্বরে বনানী কিলিং মিশনের সঙ্গে নুরী সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়টি সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘নুরী এজাহারভূক্ত আসামি। বনানি হত্যাকাণ্ডের পর তাকে আমরা অনেক দিন ধরেই খুঁজছিলাম। গতকাল শনিবার বাড্ডায় আরেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটায় নুরী। স্থানীয় জনতা তাকে ধরে ফেলে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (উত্তর) জানায়, ডিবির বাড্ডা জোনের একটি দল শনিবার দিবাগত রাতে নুরীকে নিয়ে তার সহযোগীদের ধরতে সাতারকুল এলাকায় অভিযানে গেলে সেখানে বন্দুকযুদ্ধ হয়। সেই বন্দুকযুদ্ধে নুরী প্রথমে গুলিবিদ্ধ হন। এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

ডিবির আরেক অতিরিক্ত উপ কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নুরীর কাছ থেকে উদ্ধার করা রিভলবার থেকে নিশ্চিত করা গেছে এটি দিয়েই বনানি ও বাড্ডা উভয় হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, শনিবার দুপুরে নুরীর হাতে নিহত বাদশাহ ছিলেন একজন মাদকব্যবসায়ী। টঙ্গির গাজিপুরা এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন বাদশাহ ও তার দুই সহযোগী পিচ্চি আলামিন ও সাদ্দাম। বনানীতে রিক্রুটিং  এজেন্সির মালিক সিদ্দিক হত্যায় নুরীর সঙ্গে ছিলেন এই পিচ্চি আলামিন ও সাদ্দাম। এরা দুজনই পরে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে পৃথক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এরপর ওই এলাকার একক নিয়ন্ত্রণ নেন বাদশাহ। তবে সে ঘটনার আগেই, অনেক দিন ধরে মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বাদশাহ ও পিচ্চি আলামিনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছিল। এমনকি সিদ্দিক হত্যাকাণ্ডের রাতেও বাদশাকে হাত পা বেঁধে বেদমভাবে পিটিয়েছিলেন আলামিন ও তার সহযোগীরা। স্থানীয় একটি হাসপাতালে তার শরীরে ৬০ টি সেলাই পড়ে। সুস্থ হয়ে টঙ্গি এলাকা ছেড়ে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় আস্তানা গাড়েন বাদশাহ। পরে পিচ্চি আলামিন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর টঙ্গীর মাদক ব্যবসায় ফের দখল নেন বাদশাহ। ঢাকা থেকেই সে ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন তিনি। কথা ছিলো পিচ্চি আলামিনের স্ত্রীকে এই ব্যবসার ভাগ দেবেন। কিন্তু পরে সে কথা রাখেননি বাদশাহ। আলামিনের স্ত্রী তার স্বামীর বন্ধু নুরীকে গিয়ে সে বিষয়ে নালিশ করেন। তারই জের ধরে শনিবার বাদশাহকে খুন করেন নুরী।

ঘটনার বর্ণনায় জানা যায়, দুপুরে নুরীর তার বিশ্বস্ত মাসুমকে দিয়ে বাদশাকে ডেকে আনেন। বাদশা ও তার সহযোগী মাসুম মেরুল বা্ড্ডার মাছ বাজারে আসেন। এ সময় নুরী, আরিফ ও রাজুও সেখানে পৌঁছান। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সহযোগী আলমগীর, সবুজ, মিলন ও লাল টি-শার্টপরিহিত অজ্ঞাত আরেক যুবক। বাদশার কাছে প্রথমে আলামিনের স্ত্রীর ভাগের টাকা চেয়ে না পেলে নুরী, রাজু ও আরিফ গুলি চালান।

গুলির শব্দ পেয়ে ফরিত নামে এক মাছ ব্যবসায়ী তাদের ধাওয়া দেন। এরপর অন্যরাও ধাওয়া দিয়ে এগিয়ে আসে। তখন সন্ত্রাসীদের সকলে পালালেও লাল গেঞ্জি পরিহিত অজ্ঞাত যুবকটিকে আটক করে ফেলেন তারা। ওদিকে নুরী জনতার ধাওয়ায় রামপুরা ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ব্রিজের নিচে থেকে জনতা তাকে ধরে ফেলে এবং গণধোলাই দিয়ে অস্ত্রসহ পুলিশে সোপর্দ করে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আটকের পর নুরী নিজেই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছেন।

তবে নুরীর সঙ্গে আরও বড় গ্যাংয়ের সম্পৃক্ততার তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।

গোয়েন্দা পুলিশের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, নুর ইসলাম নুরী মূলত সুইডেন প্রবাসী সাবেক ছাত্রদল নেতা নাহিদের শেল্টারেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন। ২০১৫ সালে রাজধানীর বাড্ডায় ট্রিপল মার্ডার মামলার আসামি এই নাহিদ। তার সাথে নুরীর ইমোতে নিয়মিত যোগাযোগের তথ্যও গোয়েন্দোদের কাছে রয়েছে। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ঢাকায় নুরী, আল-আমিন, সাদ্দাম, হেলাল, আরিফসহ কয়েকজন সহযোগীকে পরিচালনা করছেন নাহিদ। এরা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করা, প্রয়োজনে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মতো অপরাধ ঘটিয়ে আসছিলো। এদের মধ্যে হেলালের সঙ্গে ছিলো নাহিদের সরাসরি কানেকশন। বাকিরা হেলালের ভায়া হয়ে নাহিদের জন্য কাজ করতেন।

গোয়েন্দারা জানান, হেলালই মুলত নুরীকে চালাতেন।

বনানীর সিদ্দিক হত্যা মামলায় জেলে রয়েছেন হেলাল। জেলে বসেও তিনি নানা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা।

অপর একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, নাহিদের সঙ্গে রয়েছে গুলশানের যুবলীগ নেতা জাকিরের সুসম্পর্ক। নাহিদের পরামর্শে হেলাল, আরিফ, রাজু, নুরী, মাসুম, পিচ্চি আলামিন, সাদ্দাম, মিলন, সবুজ ও আলমগীর জাকিরের সাথেও মিশতেন। জাকির একসময় নাহিদের সঙ্গে ছাত্রদলেরই ছিলেন। তাদের দুজনের সম্পর্ক এক যুগেরও বেশি সময়ের। সেই জাকিরই এখন যুবলীগ নেতা। তিনিও এই সন্ত্রাসী দলটিকে সব ধরনের আশ্রয় দিয়ে আসছিলেন। বনানী হত্যাকাণ্ডের পর জাকির ভারতে পালিয়ে যান। বেশ কিছুদিন পর দেশে ফিরলে তিনি বনানীর মার্ডার মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। জেল থেকে তিনিও এই গ্যাংয়ের সকল অপরাধ পরিচালনায় সম্পৃক্ত রয়েছেন।

এদিকে শনিবার বাদশাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত রাজুকে নিয়েও পাওয়া যাচ্ছে তথ্য। গোয়েন্দারা জানান, রাজুও বাদশাকে গুলি করেন।  বাড্ডার পানশী হোটেলের সামনে একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় রাজু জড়িত ছিলেন, যে ঘটনায় তাকে জেলে যেতে হয়েছিলো। ২০০৫ সালে জেলে থাকা অবস্থায় নুরীর সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং পরে ঘনিষ্ট হন।

বাড্ডা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী জানান, নুর ইসলাম নুরীর বাড্ডা থানার একটি ডাকাতি মামলায় ৭ বছরের ও একটি অস্ত্র আইনের মামলায় ৩৭ বছরের জেল হয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নুরী জেলেই কাটান। এরপর হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিলার হয়ে ওঠেন।

সারাবাংলা/ইউজে/জেডএফ

 

 

 

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দেশে ফিরেছেন প্রধান উপদেষ্টা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:৫০

সম্পর্কিত খবর