Monday 07 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কাপড় নয়, স্বপ্নের বুনন!


২০ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৮:০৯ | আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৯ ১২:৪৬
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের ছুরিমঙ মারমার মেয়ে হ্লা ক্রয়নু মারমা। বান্দরবান সদর থেকে তাদের বাড়ি পৌঁছাতে সড়ক ও নৌপথে সময় লাগে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যেখানে এখনো শিক্ষা আর উন্নয়নের ছোঁয়া সেভাবে পৌঁছেনি, সেখানেই বাড়ি হ্লা ক্রয়নুদের। জুমচাষই পরিবারের একমাত্র আয়ের পথ। সপ্তম শ্রেণিতে বন্ধ হয়ে যায় পড়ালেখা।

খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার পাহাড়ি জনপদ ধর্মগড় গ্রামের রিপ্রু মারমার মেয়ে ক্রাজ্ঞোবাই মারমা। তিন ভাই-চার বোনের মধ্যে বোনদের সবার ছোট ক্রাজ্ঞেবাই। বাবার জুম চাষ এবং একটি টমটম গাড়ির উপার্জনে চলে তাদের সংসার। এসএসসিতে ফল খারাপের পর অভাবের সংসারে পড়াশোনা আর এগোয়নি ক্রাজ্ঞেবাইয়ের।

বিজ্ঞাপন

বান্দরবানের রুমা উপজেলার আরেকটি দুর্গম জনপদ নিয়াংখাং পাড়া। সেই গ্রামের থোয়াইশো প্রু মারমার মেয়ে খ্যাইমেনু মারমা। এসএসসিতে খারাপ ফল করায় তার পড়ালেখাও আর আগায় না।

পার্বত্য জেলাগুলোর যোগাযোগের সুবিধাবঞ্চিত দুর্গম এলাকাগুলোতে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারগুলোতে আছেন এমন অনেক ঝরে পড়া কিশোরী-তরুণী। স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া এসব কিশোরী-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের জীবন বদলে দিচ্ছে বান্দরবান সদরের একটি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার। উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস গত ৪২ বছর ধরে এই ট্রেনিং সেন্টারটি পরিচালনা করছে। দীর্ঘ এইসময়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারগুলোর হাজার হাজার সন্তানকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছে ‘বান্দরবান টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার’। প্রথাগত কৃষিকাজ আর নিজেদের পোশাক তৈরির বদলে সেলাই, কার্পেন্ট্রি, ইলেকট্রিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ খুঁজে নিচ্ছেন এই পাহাড়িরা।

সম্প্রতি বান্দরবান জেলা সদরে ট্রেনিং সেন্টারটিতে গিয়ে দেখা হয় সেলাই বিভাগে প্রশিক্ষণরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই কিশোরী-তরুণীদের সঙ্গে। এই বিভাগটিতে শুধুমাত্র মেয়েদের ভর্তি করা হয়। শিক্ষকের কাছ থেকে সেলাইয়ের খুঁটিনাটি শিখছেন আর কাপড় বুনছেন। চোখে তাদের একরাশ স্বপ্ন। যেন কাপড় নয়, বুনন চলছে স্বপ্নের!

কারিতাস চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক জেমস গোমেজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাহাড়ের একদম গভীরে, দুর্গম অঞ্চলে যাদের বসবাস, তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে মোটামুটি উন্নত এলাকার বাসিন্দাদের জীবনযাপনে অনেক ব্যবধান আছে। একটা সময় ছিল, যখন পাহাড়ের বাসিন্দা বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সন্তানরা নিজেদের প্রথাগত কাজের বাইরে অন্য কোনো কাজ করত না। কিন্তু এখন আমরা বলতে পারি, কারিতাসের এই ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে আমরা তাদের চিন্তাধারা বদলে দিয়েছি। চিন্তাধারা বদলের সঙ্গে তাদরে জীবনধারাও পাল্টে যাচ্ছে। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে পোশাক কারখানায় চাকরি করছে। নিজেরা দোকান দিচ্ছে। কার্পেন্ট্রি ও ইলেকট্রিক বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বাইরেও চলে যাচ্ছে। মোটামুটি এই ট্রেনিং সেন্টার নিয়ে পাহাড়ে অনেক আগ্রহ। দুর্গম অঞ্চল থেকে নিজেরাই এখন ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হতে আসছেন।’

অনুন্নত পাহাড়ি জনপদের বাসিন্দাদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে খ্রিস্টান পুরোহিত ফাদার ন্যানসন ১৯৭৪ সালে বান্দরবান জেলা সদরে এই টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৭ সালে সেটি কারিতাসের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন থেকে কারিতাসই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছে।

জানা গেছে, কারিতাসের এই টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের সেলাই বিভাগে প্রতি ছয় মাস পরপর ১২ জন করে প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি করা হয়। বাকি দু’টি ট্রেডে একবছর পর পর ১২ জন করে ভর্তি করা হয়। কম্পিউটার ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের প্রশিক্ষণও শুরু হয়েছিল, তবে এখন বন্ধ আছে। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ৩৮৬ জন এই সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

ট্রেনিং সেন্টারের অধ্যক্ষ রাখাল দাশ সারাবাংলাকে জানান, মোট ২১টি আইটেম সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে আছে— বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, শিশুদের শার্ট-প্যান্ট, বেবি ফ্রক, ইউজার প্যান্ট, টপস, স্কুল ড্রেস, বালিশের কাভার, সালোয়ার কামিজ, পেটিকোট, ব্লাউজ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের প্রথা অনুযায়ী পোশাক।

প্রশিক্ষক হ্লাসুই মারমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০০৬ সাল থেকে আমি এই সেন্টারে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বাসিন্দারা আগে তাঁতের কাপড় বুনতেন এবং সেটা পড়তেন। এখন তাঁত তেমন নেই। চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম গোষ্ঠীর কিছু তাঁতের কাজ আছে। ত্রিপুরা, মারমাসহ অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো এখন তাঁতের কাপড় বুনেন না, পরেনও না। প্রথাগত পোশাকের বাইরে এসে তারাও এখন সালোয়ার কামিজ-শাড়ি পরছেন। তারা নিজেরাই যেন নিজেদের কাপড় বুনতে পারেন, আমরা সেটা শেখাচ্ছি। আমাদের সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে বিভিন্ন বাজারে দোকান দিয়েছে। অনেকে ঢাকা-চট্টগ্রামে গিয়ে কাজ নিয়েছে। অনেকে আবার নিজেরাই এলাকায় গিয়ে অন্যান্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।’

বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার বাঘমারা গ্রামের পঙ্কজ তঞ্চঙ্গ্যার মেয়ে কণিকা তঞ্চঙ্গ্যা ২০১৫ সালে জেএসসি পরীক্ষা দিয়ে গণিতে ফেল করেন। কণিকা এখন বান্দরবান টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

কণিকা তঞ্চঙ্গ্যা সারাবাংলাকে বলেন, ‘জেএসসিতে ফেল করার পর বাবা বলেছেন, আর পড়ালেখা করতে হবে না। তখন এই ট্রেনিং সেন্টারের খবর পাই। এরপর এখানে এসে ভর্তি হই। সেলাই শিখে বাঘমারা বাজারে গিয়ে দোকান দেবো। বাবাকে সহযোগিতা করব।’

খ্যাইমেনু মারমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার দিদি অষ্টম শ্রেণিতে ফেল করার পর ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। পরে আমাদের গ্রামে গিয়ে মারমাদের কাপড় সেলাই করে। পড়ালেখাও করছে। আমিও এসএসসিতে ফেল করার পর এখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আমিও আবার পড়ালেখা শুরু করব।’
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার মং চিং হেডম্যান পাড়ার মং চা থু্ই মারমার মেয়ে চিং চিং ওয়াং মারমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেখা করেছি। অভাবের কারণে এরপর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার বাবা এখানে এতে ভর্তি করে দিয়েছে। এখানে খুব যত্ন করে সেলাই শেখানো হয়। আমি দোকান দেবো।’

ক্রাজ্ঞোবাই মারমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেলাই শিখে আয় করব। নিজের খরচ নিজেই চালাব। ফ্যামিলিকেও দেখতে পারব। কারিতাসের ট্রেনিং সেন্টারে আমাদের খুব যত্ন করে শেখানো হয়। এই ট্রেনিংয়ে আমার জন্য খুব উপকার হয়েছে।’

অধ্যক্ষ রাখাল দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শুধু ট্রেনিং দিচ্ছি না, ট্রেনিংয়ের সময় আমাদের এখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করছি। এছাড়া ট্রেনিংয়ের জন্য কোনো খরচ আমরা তাদের কাছ থেকে নিই না। সম্পূর্ণ সেবাধর্মী কার্যক্রম হিসেবে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা এই ট্রেনিং সেন্টার পরিচালনা করছি।’

খাগড়াছড়ি স্বপ্নের বুনন