সবার সঙ্গে ছিল তার আত্মার সম্পর্ক
২১ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৬:৫৬
ঢাকা: স্যার ফজলে হাসান আবেদ। শুধু নাম নয় নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। ব্যক্তিত্ব, কাজ দিয়ে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেও বাস্তবিকভাবেই তিনি ছিলেন সাধারণের কাতারে। পরিবার, প্রতিষ্ঠান সবার সঙ্গেই ছিল তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক। নীতিবাক্য বা উপদেশ নয়, জীবনে সত্যিকার অর্থে কাজে লাগবে— এমন পরামর্শই দিতেন সবাইকে। যেকোনো সমস্যাকে দেখতেন সম্ভাবনা হিসেবে। তার মৃত্যুতে দেশের ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো।
স্যার ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে এভাবেই মূল্যায়ন করেছেন আত্মীয়-পরিজন, দীর্ঘদিনের বন্ধু, সহকর্মীরা। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফজলে হাসান আবেদ। গত ২৭ নভেম্বর থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর সারাবাংলার কাছে তাকে নিয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্টজনেরা।
ড. আনিসুজ্জামান
ইমেরিটাস অধ্যাপক
ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাককে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এনজিওতে পরিণত করেছিলেন। এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সবসময় দারিদ্র্য দূরীকরণ ও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। তিনি যেমন দেশকে সম্মানিত করেছেন, একইভাবে তাকেও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে সম্মানিত করা হয়েছে। এটিও দেশের জন্য একধরনের সম্মান। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল দীর্ঘদিনের। তার মৃত্যুতে আমি শোকগ্রস্ত।
আসিফ সালেহ
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক (ফজলে হাসান আবেদের জামাতা)
পুরো পরিবারের সঙ্গে তিনি একাত্ম থাকতেন। তার এই বিষয়টি আমাকে অবাক করে। ভাই-বোন, ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের প্রত্যেকের সম্পর্কে আলাদাভাবে জানতেন। সবার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে তাদের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান দিতেন। তিনি খুব প্রাগম্যাটিক, প্র্যাকটিক্যাল কথা বলতেন। তিনি কখনো কোনো নীতিবাক্য বা উপদেশ দিতেন না। সবাইকে বাস্তবসম্মত পরামর্শ দিতেন। অর্থাৎ নীতিবাক্য বা উপদেশ নয়, জীবনে সত্যিকার অর্থে কাজে লাগবে— এমন পরামর্শই দিতেন। তার বাসার গৃহসহকারীরা তার বাসায় বছরের পর বছর কাজ করতেন। তাদের সবার পারিবারের খোঁজখবর রাখাসহ তাদের সমস্যার সমাধানও করতেন তিনি। তারাও ব্যক্তিগতভাবেই তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। মৃত্যুর আগের কিছুদিন তাকে যারা দেখাশোনা করতেন, তাদের রাতে বাড়ি ফিরতে সমস্যা হলে আগেই চলে যেতে বলতেন। বলা যায় সবার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক ছিল ফজলে হাসান আবেদের।
ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক
কেউ তাকে স্যার বলতেন না। গাড়ির ড্রাইভার থেকে শুরু করে সবাই তাকে ভাই বলতেন। তার গ্রামের বাড়ি থেকে একশ গজ দূরে ছিল আমার বাড়ি। তাই এলাকার মানুষ হিসেবেও তার সঙ্গে আলাদা সম্পর্ক ছিল আমার। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় করার সময় তিনি আমাকে ডেকে বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় তোমার কাছ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় নেয়, আমাকেও সেই সময় দাও। আমি তার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ গুছিয়ে দেই।
তিনি বলতেন, কোনো সমস্যা নিয়ে নয়, সম্ভাবনা নিয়ে আমার কাছে আসবে। সমস্যাকে সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাব। তাকে কখনো রাগতে দেখিনি। কোনো কারণেই তিনি কখনো সংকীর্ণতায় ভুগতেন না। সবসময় তার মুখে প্রচ্ছন্ন হাসি লেগেই থাকত। ব্র্যাকের মাধ্যমে প্রচুর নারী-শিশুকে তিনি যেভাবে সাহায্য করতেন, সেভাবে তারা সবসময় তাকে স্মরণ রাখবেন। সবকিছুর পরে তিনি একজন বিনয়ী মানুষ ছিলেন।
শাইখ সিরাজ
পরিচালক ও বার্তা প্রধান, চ্যানেল আই
স্যার ফজলে হাসান আবেদের কাছাকাছি যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল অনেকবার। আমি তার সঙ্গে উগাণ্ডায় ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের স্পেশাল ম্যাল নিউট্রিশনের একটি প্রজেক্টে কাজ করেছি। তার সঙ্গে কাজ করার যে ব্যপ্তি, যে অভিজ্ঞতা, তা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
প্রায় ২৫ বছর আগে মাধবপুরের একটি গ্রামে একটা কাজে গিয়ে হঠাৎ বাচ্চাদের আওয়াজ শুনে এগিয়ে যাই। গিয়ে দেখি সেখানে ব্র্যাকের একটা স্কুল। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত কোনো অঞ্চলে এতবছর আগে এমন স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা ভাবাই ছিল কঠিন। অথচ তিনি ওই সময়ই তা করে দেখিয়েছেন। সরকারের পাশাপাশি এদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে তার ভূমিকা কেউ ভুলবে না কখনো। এছাড়া, ব্র্যাকের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ গণউন্নয়ন কর্মকাণ্ড আমাদের দেশকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আরও পড়ুন-
কে ছিলেন, কেমন ছিলেন ফজলে হাসান আবেদ
নিরলস শ্রমের এক অবিস্মরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব
ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
অবসরে ফজলে হাসান আবেদ, ব্র্যাকের দায়িত্বে হোসেন জিল্লুর