Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নিপাহ ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক নয়, প্রতিরোধে দরকার সচেতনতা


২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৬:২৭

ঢাকা: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী এক ভাইরাসের নাম নিপাহ। এই ভাইরাসটি সাধারণত ফল খাওয়া বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নিপাহ ভাইরাস একটি মরণব্যাধি রোগ। বাংলাদেশে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা খুব একটা বেশি না হলেও এতে মৃতের হার বেশি। যা আক্রান্ত রোগির প্রায় ৭০ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিপাহের এখন পর্যন্ত কোনো টিকা ও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তাই সতর্কতা ও সচেতনতাই এই রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। আর তাই নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকি এড়াতে খেজুরের রস ফুটিয়ে পান করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, সাধারণত দুইভাবে আমাদের দেশে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ হয়। শীতকালে খেজুড়ের রস পাওয়া যায়। সেই রস না ফুটিয়ে খেলে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ রাতের বেলায় বাদুড় রস পান করার জন্য খেজুড় গাছের কাটা অংশে বা বাঁশের পাইপে মুখ দেয়। এ সময় এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে।

তিনি আরও বলেন, শীতকালেই দেখা যায় বাদুড় অর্ধেক ফল খেয়ে পথে ফেলে রাখে। সেই ফল যদি কেউ মুখে দেয় তবে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে।

এক্ষেত্রে শীত মৌসুমে খেজুড়ের রস ফুটিয়ে খাওয়া এবং পথে পাওয়া ফল না খাওয়ার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

তিনি বলেন, আতঙ্ক ছড়িয়ে নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধ করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি করা। যেহেতু ঢাকা শহরে খুব কম অঞ্চলেই খেজুরের রস পাওয়া যায় ও বাদুড়ও কম দেখা যায় তাই এখানে ঝুঁকি কিছুটা কম। তবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে বাদুর আছে সেখানে ঝুঁকি থাকে। আর এক্ষেত্রে সচেতনতাই পারে এই রোগ প্রতিরোধ করতে।

বিজ্ঞাপন

শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সফি আহমেদ মুয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি বা সংস্পর্শে এলেও রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও এই রোগে আক্রান্ত রোগীর কাপড়, ব্যবহৃত বিছানা, এমনকি গামছাও যদি অন্য কেউ ব্যবহার করে তবে নিপাহ হতে পারে। এই ক্ষেত্রে তাই রোগ প্রতিরোধের জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।

তিনি বলেন, বাদুড়ের মুখ দেওয়া খেজুরের রস বা ফল খাওয়ার ছয় থেকে সাত দিন পরে নিপাহ ছড়ায়। নিপাহ আক্রান্ত ব্যক্তির সুস্থ হতে সময় লাগে আরও ১০ থেকে ১৫ দিন। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কে ইনফেকশন ছাড়াও শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও মাথাব্যথা হয়ে থাকে।

নিপাহ প্রতিরোধের জন্য এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, শীতকালে খেজুরের রস কাঁচা খাওয়া যাবে না, ফুটিয়ে খেতে হবে। রাস্তায় পড়ে থাকা ফল খাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে আসলে সচেতন থাকা এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।

শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রিজওয়ানুল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, শীতকালে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই মৌসুমে আমরা এখনো নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায় নি।

এ দিকে শীত মৌসুমে কাঁচা খেজুরের রস থেকে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।

জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, শীতকাল এলেই রাজধানীসহ দেশে খেজুরের রস খাওয়ার উৎসব শুরু হয় । সেখানে দেখা যায় কাঁচা খেজুরের রসই সবাই পান করে। তবে এই খেজুরের রস ফুটিয়ে পান করলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না।

তিনি বলেন, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঘটনা ঘটে জানুয়ারি থেকে মার্চে। তাই আমরা ধরেই নেই খেজুরের রস যেহেতু ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাওয়া যায়, সেখান থেকে নিপাহে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, তাই এ সময়ে খেজুরের রস বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য কাঁচা খেজুর রসের পরিবর্তে জ্বাল দিয়ে রস খাওয়াটাকেই উৎসাহিত করতে হবে।

আইইডিসিআরর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি না। তবে এই রোগের আমাদের দেশে মৃতের হার ৭০ শতাংশ। ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩১৩ জন। এর মধ্যে ২১৭ জন মারা গেছে বলে জানান তিনি।

আইইডিসিআর’র সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. শারমীন সুলতানা বলেন, নিপাহ একটা ভাইরাসজনিত রোগ। এর লক্ষণগুলো হলো, জ্বর, মাথাব্যথা, প্রলাপ বকা, অজ্ঞান ও শ্বাসকষ্ট হওয়া।

তিনি বলেন, কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া এবং কারো কাছে কাঁচা খেজুরের রস বিক্রি করা উচিত নয়। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। নিপাহ ভাইরাসের কোনো চিকিৎসা নেই। এই রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে শুধুমাত্র আইসিডিডিআর,বি ও আইইডিসিআরে।

উল্লেখ্য, ১৯৯৮-৯৯ সালে মালয়েশিয়ার সুঙ্গাই নিপাহ নামক গ্রামে নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় প্রথম। ঐ গ্রামের নামেই ভাইরাসটির নামকরণ করা হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা গেছে, মৃত রোগীর মাধ্যমেও এই রোগ ছড়ায়। ২০১৯ সালে ৮ জন নিপাহে আক্রান্ত হয় এবং এর মধ্যে চার জন মারা যায়। এই আট জনের মধ্যে পাঁচ জন ছিল একই পরিবারের।

মালয়েশিয়ায় নিপাহে মৃত্যু হার ৪০ শতাংশ হলেও আমাদের দেশে মৃত্যু হার ৭০ শতাংশ। দেখা গেছে আমাদের দেশের নিপাহ ভাইরাস শক্তিশালী। আর তাই বিশেষজ্ঞরা প্রতিরোধের চাইতে বেশি সচেতনতাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন।

জ্বর নিপাহ নিপাহ ভাইরাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর