‘৮ বছরে একদিনও দায়িত্ব পালন করেননি আবাসিক সার্জন ডা. নজরুল’
২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ২০:০৫
ঢাকা: রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মো. নজরুল ইসলাম। পদে আবাসিক সার্জন হলেও গত আট বছরে একদিনের জন্য দায়িত্ব পালন করেননি তিনি— সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ জমা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদকে)।
ডা. নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ— তিনি পেশায় চিকিৎসক হলেও নিজেকে পরিচয় দেন বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। এ ছাড়া অনুমোদন ছাড়া হাসপাতালের সম্পদ বিক্রি, জোর করে হাসপাতালের একাধিক কক্ষ দখলে রাখাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
দুদকে আসা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে— ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতর এক প্রজ্ঞাপন জারি করে ডা. মো. নজরুল ইসলামকে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার শূন্য পদে নিজ বেতনে পদায়ন করে। কিন্তু একজন ডাক্তারকে ইঞ্জিনিয়ার পদে নিয়োগ দেওয়ায় ওইসময় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে স্বাস্থ্য অধিদফতর তার নিয়োগ বাতিল করে। এ ছাড়া বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার পদের জন্য বিএসসি ডিগ্রি লাগলেও তার এ ডিগ্রি নেই।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে—নজরুল ইসলামের উচ্চতর ডিগ্রি ও যোগ্যতা না থাকার পরেও দীর্ঘদিন যাবত আরএস (অর্থপেডিক) পদে কর্মরত আছেন। গত ৮ বছর যাবত আবাসিক সার্জনের পদে থাকলেও কখনই এ দায়িত্ব পালন করেননি তিনি। অধিকাংশ সময় অনুপস্থিত থাকেন হাসপাতালে। তিনি বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার এবং বায়োমেডিকেল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে পরিচয় দেন।
এমনকি কক্ষ সংকটে হাসপাতালের সেবা ব্যহত হলেও বায়োমেডিকেল বিভাগের নামে চারটি বড় বড় কক্ষ দখল করে রেখেছেন তিনি। আধুনিকসজ্জিত এসব কক্ষ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন এ চিকিৎসক।
দুদকে আসা অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, নজরুল ইসলাম একাধারে আরএস (অর্থপেডিক) ও বায়োমেডিকেল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পরবর্তীতে ম্যানেজার (মেইনটেনেন্স) পদ দখল করে ছিলেন। ম্যানেজার দ্বিতীয় শ্রেণির পদ হলেও প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হয়ে শুধুমাত্র বাড়তি আয়ের লোভে এই পদ আকড়ে ধরে ছিলেন। পিডব্লিউডির কাছ থেকে কমিশন হাতানোর জন্য দীর্ঘদিন এ পদ ধরে রেখেছিলেন। হাসপাতালের আবাসন সংকটের কারণে ডক্টরস কোয়ার্টারে প্রত্যেকটি বাসার ওপর-নিচে দুজন করে ডাক্তার বসবাস করেন। কিন্তু নজরুল ইসলাম একাই এইচডি-১৪ ভবনটি দখল করে রেখেছে। বাসাটিতে অন্য ডাক্তারকে বরাদ্দ দিলেও তাদের উঠতে দেওয়া হয়নি।
শুধু তাই নয়, হাসপাতালে মালামাল কেনাকাটায় একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তিনি। তার বন্ধুর প্রতিষ্ঠান আমাস টেকনোলজির মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে কম্পিউটার ও সিসি ক্যামেরা কেনাকাটা করেন। নিয়মানুযায়ী এসব মালামাল স্টোর কিপারের দায়িত্বে থাকার কথা। কিন্তু কখনই এসব মালামাল স্টোর কিপারকে হস্তান্তর করেননি নজরুল। এনআইসিভিডি’র একটি এনজিওপ্লাস্টি মেশিনসহ বেশ কিছু মেশিন পরিত্যাক্ত অবস্থায় অর্থোপেডিক বহির্বিভাগে ছিল। কিন্তু তিনি নামমাত্র দামে এগুলো বিক্রি করে দেন। এতে রাষ্ট্রের অর্ধকোটি টাকা লোকসান হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এই ঘটনা গণমাধ্যমে এলে ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. রওশন আনোয়ারকে। সে কমিটির কোনো রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি।
ডাক্তার নজরুল ইসলাম ২০০৫ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দুই বছর সরকারি কোনো অনুমোদন ছাড়া আমেরিকায় অবস্থান করেন। সে জন্য তার চাকরি চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু সেই শাস্তি থেকেও পার পেয়ে যান রহস্যজনক কারণে। তখন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেটিও আলোর মুখ দেখেনি। দেশ থেকে অর্থপাচার করে আমেরিকায় বাড়ি-গাড়ি করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সরেজমিনে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে তিনি বহিঃর্বিভাগে দ্বিতীয় তলার ১৩ নম্বর ব্লকে বায়োমেডিকেল অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান দাবি করে রুম দখল করে বসেন। কিন্তু তার দায়িত্ব পালন করার কথা বহির্বিভাগে প্রথম তলার ১ নম্বর ব্লকে আরএস অর্থোপেডিক বিভাগ।
নজরুলের দুর্নীতির বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, তার দুর্নীতির কোনো শেষ নেই। তার বিরুদ্ধে শতশত অভিযোগ হলেও মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এছাড়া দীর্ঘ ৮ বছর যাবৎ তিনি আবাসিক সার্জন (অর্থপেডিক) পদে থাকলেও তিনি কখনো এই পদে দায়িত্ব পালন করেননি। অধিকাংশ সসময়ে অনুপস্থিত থাকেন হাসপাতালে।
অভিযোগের বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মো. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সব অভিযোগ বানোয়াট। এ সবের কোনো ভিত্তি নেই।’ অবৈধভাবে রুম দখলসহ মাদক সেবন ও বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি।
নজরুল ইসলামের দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ড. উত্তম কুমার বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘অভিযোগটি আমরা পেয়েছি। এ অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি (শনিবার) গঠন করেছি। সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জারি বিভাগ ডা. মো. নজরুল ইসলাম শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল