দুই মেয়েকে নিয়ে না ফেরার দেশে মিন্টু, সংজ্ঞাহীন স্ত্রী ও ছেলে
২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৯:০২
চট্টগ্রাম ব্যুরো : স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে সাজানো সুখের সংসার ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক সাইফুজ্জামান খান মিন্টুর। বড় মেয়ে ক্যাডেট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল- সবচেয়ে আনন্দের অনুষঙ্গ ছিল তাদের পরিবারে সেটাই। বার্ষিক পরীক্ষা শেষের দিন মেয়েকে ফেনীতে স্কুল থেকে নিয়ে বান্দরবানের গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে পুরো পরিবার। ফেরার পথে একটি দুর্ঘটনা সাজানো-গোছানো পরিবারটিকে তছনছ করে দিয়েছে। দুই মেয়েসহ না ফেরার দেশে মিন্টু আর আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি মিন্টুর স্ত্রী ও ছেলে।
প্রাইভেটকারে লরির ধাক্কা, দুই মেয়েসহ ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু
শনিবার (২৮ ডিসেম্বর ) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে এসব জানিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সাইফুজ্জামান খান মিন্টুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় কুমার বসাক।
তিনি জানান, মিন্টুর স্ত্রী কণিকার মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার কিছু বলার শক্তি নেই। ছেলে মন্টি তখন থেকেই সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আছে।
বিজয় কুমার বসাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্ট ভিন্ন হলেও কিন্তু উঠাবসা একসাথে ছিল। মিন্টু খুবই বন্ধুবৎসল ছিল। ভালো গান গাইত। আড্ডা দিত। এক কথায় সবাইকে মাতিয়ে রাখত। ভাবি আর বাচ্চাদের নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। কয়েক মাস আগে জার্মানিতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসে। ঘুরতে খুব ভালোবাসত। ছুটি পেলেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেত। আকস্মিকভাবে এমন একটি দুর্ঘটনায় তাকে হারাব, সেটা কখনোই ভাবিন।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এস এম নোমান খালেদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘কণিকার মাথায়, কোমরে ও হাতে গুরুতর জখম আছে। ছেলের মাথায় জখম বেশি। দুজনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। তবে কণিকার অবস্থা ছেলের চেয়ে কিছুটা উন্নত আছে।’
মিন্টুর স্ত্রী ও ছেলে- দুজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িতে দায়িত্বরত পরিদর্শক জহিরুল ইসলাম। এছাড়া পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়া তিনটি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এর আগে,সকালে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে শনিবার দুপুরে হাসপাতালে ছুটে আসেন সাইফুজ্জামানের তিন ভাই। এরা হলেন- কুমিল্লার সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জেড আই মিজানুর রহমান খান, কক্সবাজারে বিজিবির একটি ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক কর্ণেল জেড আই নজরুল ইসলাম খান এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জেড আই মনিরুজ্জামান খান। এসময় সেখানে ছিলেন নজরুলের বন্ধু চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোজাম্মেল হোসেন, নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় কুমার বসাকসহ আত্মীয়স্বজনরাও।
আকস্মিক স্বজন হারানোর বেদনায় হাসপাতালে আসা পরিবারের সদস্য-সহকর্মী- শুভার্থীরা ছিলেন নির্বাক। তারা শুরু থেকেই ছিলেন নির্বাক। আকস্মিক এত বড় দুর্ঘটনায় কারও মুখ দিয়ে যেন একটি শব্দও বেরুচ্ছে না।
বিকেলে নজরুলের স্ত্রী ডা. জেসি খান হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে আসার পর রুদ্ধ আবেগের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
মিজানুর রহমান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিবারের সবাইকে নিয়ে বান্দরবানে বেড়াতে গিয়েছিল। ফেরার পথে এত বড় একটি ঘটনা ঘটে গেছে। মিন্টু দুই মেয়েকে নিয়ে চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। চিকিৎসাধীন মিন্টুর স্ত্রী কণিকার মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরলেও ছেলে মন্টি এখনও সংজ্ঞাহীন।
তিনি জানান, চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের সন্তান জেড আই সাইফুজ্জামান খান মিন্টু (৪৫)। পরিবারে পাঁচ ভাই ছয় বোনের মধ্যে মিন্টু দশম। স্ত্রী কণিকা জামান খান (৩৯) গৃহিণী। বড় মেয়ে আশরা জামান খান (১৩) ফেনী ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। মেঝ মেয়ে তাসনিম জামান খান (১১) ও ছেলে মন্টি খান (১০) ঢাকার একটি স্কুলের চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
ঢাকার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যুগ্ম পরিচালক হিসেবে কর্মরত সাইফুজ্জামান খান মিন্টু পরিবার নিয়ে থাকতেন মিরপুর এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদে যোগ দিয়েছিলেন সাইফুজ্জামান।
নজরুলের বন্ধু মোজাম্মেল হোসেনের বাসা নাসিরাবাদে আপন নিবাস আবাসিক এলাকায়। তিনি সারাবাংলাকে জানান, গত ২৩ ডিসেম্বর সাইফুজ্জামানের বড় মেয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়। ওইদিন দুপুরে সাইফুজ্জামান স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেন। ফেনী ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজের গেইট থেকে বড় মেয়েকে তুলে নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন। চট্টগ্রামে আসার আগে মোজাম্মেলকে ফোন করে জানিয়েছিলেন- তাদের বাসায় উঠবেন এবং রাতে ভাত খেয়ে বান্দরবানের উদ্দেশে রওনা দেবেন।
‘কথা দিয়েছিল, আমার বাসায় আসবে। ভাত খাবে। আমি বাজার সদাই করি। কিন্তু আসেনি। ঢাকা থেকে নিজেই প্রাইভেট কার চালিয়ে এসেছিল। সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসে পার্কিং করে রেখে জিপ নিয়ে চলে যান বান্দরবান। শনিবার ভোরে বান্দরবান থেকে ফিরে প্রাইভেট কারটি চালিয়ে ফিরে যাচ্ছিল ঢাকায়। পথে দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেল।’ বলেন মোজাম্মেল হোসেন
শনিবার সকাল ৯টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাট বাইপাস মোড়ে ঢাকামুখী প্রাইভেট কার ও চট্টগ্রামমুখী কনটেইনারবাহী লরির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। প্রাইভেট কারে ছিলেন সাইফুজ্জামান খান মিন্টু ও তার স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং ছেলেসহ মোট পাঁচজন। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের টিম গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে দুই মেয়ের লাশ উদ্ধার করেন। আহত তিনজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মিন্টু মারা যান।