Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বছরজুড়ে আলোচনায় খেলাপি ঋণ, পুঁজিবাজারে দরপতন, পেঁয়াজের দাম


৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৭:৫০

ঢাকা: ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে বছরজুড়ে আলোচনার বিষয় ছিল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, ব্যাংকের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা, পুঁজিবাজারে দরপতন, পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। এছাড়াও বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং বন্ধ (অবসায়ন) ঘোষণা, বাজেটে ঘাটতি মোকাবিলায় রেকর্ড পরিমাণ ব্যাংক ঋণ নেওয়া, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়া, কোরবানির পশুর চামড়ার রেকর্ড দরপতন এবং রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া নিয়ে আলোচনা চলেছে বছরজুড়ে। তবে অর্থনীতিতে আশার আলো দেখিয়েছি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স।

বিজ্ঞাপন

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে নতুন রেকর্ড: ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের গত ১০ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সব ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ঘোষণা করেন, ‘আজ থেকে খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না।’ অর্থমন্ত্রীর এমন ঘোষণার পরও চলতি বছরের প্রথম নয় মাসেই (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ সংখ্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ। তবে এখনও বছরের শেষ তিন মাসের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। বছরের শেষ তিন মাসের খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন (সেপ্টেম্বর -ডিসেম্বর)প্রকাশ হলে প্রকৃত পরিমাণ আরও বাড়বে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের প্রকৃত খেলাপি ঋণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা হলেও বাস্তবে ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)‘র হিসাবে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট ৪০ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়।

ডিএসইর প্রধান সূচক সাড়ে চার বছর আগের অবস্থানে: চলতি বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে দরপতন ছিলো চোখে পড়ার মতো। বছরব্যাপী পুঁজিবাজারে দরপতনের কারণে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। টানা দরপতনে ডিএসইর প্রধান সূচক আগের ৪২ মাসের মধ্যে বর্তমানে সর্বনিম্ন। গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক চার হাজার ৪১৮ পয়েন্টে নেমে আসে। এটি ২০১৬ সালের ২৭ জুনের পর সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান।

এদিকে পুঁজিবাজারে দরপতনের কারণে চলতি বছরে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৯৬৭ পয়েন্ট। একই সময়ে ডিএসই বাজার মূলধন হারিয়েছে ৪৮ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। এছাড়াও মন্দা বাজারের কারণে পুঁজিবাজারের ইতিহাসে চলতি বছরে পুঁজিবাজার থেকে সবচেয়ে কম অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে পুঁজিবাজার থেকে মাত্র ৬৪১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা সংগ্রহ হয়। এটি গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি: চলতি বছরের আগস্ট থেকে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। জুলাই মাসের শুরুতে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৪০ টাকা হলেও আগস্টের শুরু থেকে দাম বাড়তে শুরু করে। সেপ্টেম্বর মাসে পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে গত অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পেঁয়াজের রেকর্ড পরিমাণ দাম বেড়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা দরে। যা নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে সরকার প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়ে।

পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার মিশর, তুরস্ক, চীন, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে জাহাজে করে পেঁয়াজ আমদানি করে। এছাড়াও সরকার প্রথমবারের মতো উড়োজাহাজে করে পেঁয়াজ আমদানি করে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এছাড়াও পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে খোলা বাজারে ৪৫ টাকা কেজিতে টিসিবি পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করে। তবুও পরিস্থিতি পুরোপুরি সামাল দেওয়া যায়নি।

পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (পিএলএফসিএল): বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৬ জুন অর্থমন্ত্রণালয় পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের অনুমোদন দেয়। এতে করে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরুর ২২ বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। এটি ছিল বাংলাদেশে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা। এতে করে প্রতিষ্ঠানটিতে আটকে পড়ে বিভিন্ন আমানতকারীর ২ হাজার ৩৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যক্তি শ্রেণির ৬ হাজার আমানতকারীর অমানতের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা, অবশিষ্ট ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা রয়েছে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের।

চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আর্থিক হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, পিপলস লিজিং-এর সম্পদের পরিমাণ মাত্র ১ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে কোম্পানিতে আমানতকারীদের পাওনার পরিমাণ ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। আমানত ও সম্পদের ব্যবধান ৬৯৮ কোটি টাকা। ফলে আমানতকারীদের একটা বড় অংশ তাদের আমানতের টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আর নেই।

ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা ও সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা: ২০১৯-এ বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি। একইসঙ্গে ব্যাংকের ঋণ সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার বিষয়টিও ছিল আলোচনার কেন্দ্রে।

চলতি বছরে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দেন ঋণখেলাপিরা ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সরল সুদে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করে তা পরিশোধ করতে পারবেন। সব ধরনের ঋণখেলাপিরাও এই সুযোগ পাবেন। এই ক্ষেত্রে ঋণখেলাপিদের প্রথম এক বছর কোনো কিস্তিও দিতে হবে না। অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিতে বিশেষ নির্দেশনা জারি করেছে। যা নিয়ে বছরজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও অর্থমন্ত্রী তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর অর্থমন্ত্রী ব্যাংকগুলোকে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেন। বিনিময়ে ব্যাংকগুলোর করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়, বিএবি‘র চাহিদা অনুযায়ী সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, সিআরআর ১ শতাংশ কমিয়ে আনা, ঋণ আমানতের হার (এডিআর) সমন্বয়সীমার সময় বাড়ানো এবং রেপো রেট ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করাসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়। বিনিময়ে ব্যাংকগুলো প্রতিশ্রুতি দেয় তারা ব্যাংকের সুদের হার আমানতের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ এবং ঋণের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ নির্ধারণ করবে। কিন্তু সরকারি ব্যাংক বাদে বেসরকারি অধিকাংশ ব্যাংকই তা বাস্তবায়ন করেনি। চলতি বছরের ২৩ জুলাই ব্যাংক আমানত ৬ ও ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরেও ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামেনি।

এছাড়াও চলতি ২০১৯ সালে বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় ছিল কোরবানির পশুর চামড়ার উপযুক্ত দাম না পেয়ে মূল্যবান এই সম্পদ অনেকে রাস্তায় ফেলে দেওয়ার ঘটনাগুলো। আবার কোথায়ও কোথায়ও পশুর চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। এতে করে সরকার প্রথমবারের মতো কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

অন্যদিকে চলতি বছরের শেষ দিকে এসে সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে, কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ। পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতের রফতানি প্রবৃদ্ধি কমেছে, কমেছে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা।

প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে: চলতি বছর ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাত, পুঁজিবাজার, রফতানি প্রবৃদ্ধিসহ অর্থনীতি উল্টোপথে হাঁটলেও বছরজুড়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল ঊর্ধ্বমুখি। যা দেশের অর্থনীতিতে গতিশীল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৯ সালের প্রথম থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে থাকে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ ১৫৯.৭২ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়। এরপর ফেব্রুয়ারিতে ১৩১.৭৭, মার্চে ১৪৫.৮৬, এপ্রিলে ১৪৩.৪৩ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আসে। মে মাসে নতুন রেকর্ড গড়ে রেমিট্যান্স আসে ১৭৪.৮১ কোটি মার্কিন ডলার। পরবর্তীতে জুনে ১৩৬.৮২ কোটি ডলার, জুলাইয়ে ১৫৯.৭৬ কোটি মার্কিন ডলার, আগস্টে ১৪৪.৪৭, সেপ্টেম্বরে ১৪৭.৬৯, অক্টোবরে ১৬৩.৯৬ এবং নভেম্বর মাসে ১৫৫.৫২ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আসে।

চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে দেশে রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ৬৬৩ কোটি ৮১ লাখ মার্কিন ডলার। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বছরের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। যদিও ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ অরও বেড়ে নতুন উচ্চতা স্পর্শ করে। এর আগে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৫৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। চলতি বছরের ১১ মাসেই তা ছাড়িয়ে গেছে।

২০১৯ সাল খেলাপি ঋণ পুঁজিবাজার পেঁয়াজের দাম সালতামামি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর