Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘খুন হওয়া’ ছাত্রলীগ নেতার মায়ের তোপের মুখে মেয়র নাছির


৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৮:৪৬

চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রামে কৃষক লীগের একটি অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মায়ের তোপের মুখে পড়েছেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনবছর আগে নির্মম হত্যার শিকার দিয়াজের মা এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। সন্তান ‘হত্যার’ বিচারে অনিশ্চয়তার জন্য মেয়রকে দোষারোপ করেন তিনি। এ নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে কিছুক্ষণের জন্য বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক মিলনায়তনে এই ঘটনা ঘটেছে। সেখানে চট্টগ্রাম মহানগর কৃষক লীগ ‘সন্ত্রাস-দুর্নীতি ও মাদকবিরোধী’ শপথগ্রহণ ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি সমীর চন্দ। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ছিলেন প্রধান বক্তা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার সকালে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন যখন প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানে আসেন তখন সেখানে কৃষক লীগের নেত্রী জাহেদা আমিন চৌধুরী বক্তব্য দিচ্ছিলেন। মেয়র মঞ্চে ওঠার সময় হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন তিনি। বক্তব্যের মধ্যেই তিনি দিয়াজের মৃত্যু নিয়ে মেয়রকে দোষারোপ করে বিভিন্ন কথা বলতে শুরু করলে সেখানে হট্টগোল শুরু হয়। এতে মেয়রের অনুসারী নেতাকর্মীরা জাহেদাকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন বলে অভিযোগ তার। এক পর্যায়ে মিনিট বক্তব্য দিয়ে নেমে যান জাহেদা । পরে দর্শকসারিতে বসে কাঁদতে থাকেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহেদা আমিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি শুধু মেয়রকে জিজ্ঞেস করেছি- দিয়াজের মরদেহের ময়নাতদন্তের আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার কেন আপনার বাসায় গিয়েছিলেন? আর উনি কেন দিয়াজ আত্মহত্যা করেছেন বলে রিপোর্ট দিলেন? দিয়াজ তো আপনাকে (মেয়র) বাবার মতো জানত, তাহলে তার হত্যার বিচারের জন্য আমরা আপনাকে পাশে পাচ্ছি না কেন? কিন্তু আমি এই প্রশ্ন করার পরই তার লোকজন হইচই শুরু করেন। মেয়র নিজে বলতে থাকেন, আমি সব সময় আপনাদের পাশে আছি। আমি বললাম, মিথ্যা কথা। আপনার কারণে সিআইডি চার্জশিট দিতে পারছে না, আপনি আমাকে বলেছিলেন— আসামির তালিকা থেকে আলমগীর টিপুর নাম বাদ দিতে। আমি বাদ দেইনি বলে আপনি চার্জশিট দিতে দিচ্ছেন না। এসব কথা বলার পর আমাকে কয়েকজন মিলে মঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়। আমি একপাশে চেয়ারে বসে কাঁদতে থাকি।’

এরপর মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন যখন বক্তব্য দিতে ওঠেন, তখন জাহেদা অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখান থেকে চিৎকার করে মেয়রের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘একটি নাম শোনো নবীন, আ জ ম নাছির উদ্দীন— এই স্লোগান তো দিয়াজ বানিয়েছিল। আমার ছেলেকে বলেছিলাম, এমন এক নেতার গ্রুপ করিস, যিনি মানুষকে উঠতে দেন না। মানুষ উঠতে গেলেই নাকি তিনি হত্যা করেন। দিয়াজ আমাকে বলেছিল, আম্মা উনি (মেয়র) আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করেন।’

জাহেদা আমিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি যখন বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, তখন মেয়রের পিএস রায়হান এবং নীল শার্ট পরা একটা ছেলে এসে আমাকে ‍হুমকি দেয়। তারা আমাকে তুই সম্বোধন করে কথা বলে। সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেয়। আমি যখন বললাম, তোমরা কি আমাকে দিয়াজের মতো খুন করবে ? তখন রায়হান বলে, আপনি মানসিক রোগী। আমি বললাম, সত্য কথা বললে তাকে তোমরা মানসিক রোগী বানিয়ে দাও।’

তবে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ নাকচ করে মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী রায়হান উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়র সাহেব যখন সেখানে যান, তখন দিয়াজের মা বক্তব্য দিচ্ছিলেন। হঠাৎ উনি এমন আবেগপ্রবণ হয়ে যান, মেয়র সাহেবকে দোষারোপ করে বক্তব্য দিতে শুরু করেন। আবার অনুরোধও করেন। আমরা পেছনে বসেছিলাম। কৃষক লীগের নেতারাই উনাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে নেন। আমরা কিছুই বলিনি। পরে উনি আবার নিজ থেকে বেরিয়ে বাইরে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করেন। আবারও মেয়র সাহেবকে নিয়ে নানা কথাবার্তা বলতে শুরু করলে আমি সেখানে যাই। আমার সঙ্গে খুবই ভালোভাবে কথা হয়েছে। হুমকি দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।’

দিয়াজের বড় বোন জুবাইদা সরওয়ার নিপা সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রেসক্লাবে গিয়ে আম্মা আমাকে ফোন করেন। তিনি বললেন, সেখানে নাকি নওফেল ভাইকে (শিক্ষা উপমন্ত্রী) প্রধান অতিথি করার কথা ছিল, কিন্তু তিনি গিয়ে ব্যানারে দেখছেন মেয়র সাহেবকে অতিথি করা হয়েছে। আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর মেয়র সাহেবের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে আমার মায়ের স্বাভাবিক কিছু ক্ষোভ আছে। উনি সহজ হতে পারেন না। ’

দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী চট্টগ্রাম মহানগর কৃষক লীগের নবগঠিত কমিটির মহিলা সম্পাদিক। দিয়াজ ইরফান চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন। ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট এলাকায় ভাড়া বাসায় নিজ কক্ষ থেকে দিয়াজের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দিয়াজের মরদেহের প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলা হয়। কিন্তু তার পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, আত্মহত্যা নয় দিয়াজকে খুন করা হয়েছে।

ঘটনার পর ২৪ নভেম্বর জাহেদা আমিন চৌধুরী বাদী হয়ে আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হলেন— চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি আলমগীর টিপু, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল মনসুর জামশেদ, বিলুপ্ত কমিটির প্রচার সম্পাদক রাশেদুল আলম জিসান, ছাত্রলীগ কর্মী আবু তোরাব পরশ, মনসুর আলম, আব্দুল মালেক, মিজানুর রহমান, আরিফুল হক অপু ও মোহাম্মদ আরমান। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৮-১০ জনকে আসামি করা হয়েছিল। মামলার আসামি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দিয়াজও নাছিরের অনুসারী ছিলেন।

ছেলের মৃত্যুর পর থেকে জাহেদা আমিন অভিযোগ করে আসছিলেন দিয়াজকে হত্যা করা হয়েছে। আর এই হত্যাকাণ্ডটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত নিজের অনুসারীদের বাঁচাতে মেয়র প্রভাব বিস্তার করছেন।

দিয়াজ ‘হত্যার’ বিচার চেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাহেদা আমিনের আর্তি বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে এসেছে। ছেলে হত্যার বিচারের দাবিতে একাধিকবার কর্মসূচি পালন করেছেন তিনি। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন জাহেদা আমিন। এর আগে ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনশন পালন করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

জাহেদা আমিন দিয়াজ দিয়াজ হত্যা মেয়র নাছির


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর